রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট
বিশ্বরাজনীতিতে নয়া মেরুকরণ
রাশিয়া ও ইউক্রেনের চলমান পরিস্থিতি একটি সংকটে রূপ নিয়েছে এবং পশ্চিমা দেশগুলো মোটা দাগে এই সংকট তৈরি করেছে। সেই সংকটের পেছনে ন্যাটোর পূর্বমুখী এক্সপ্যানশন, যা তারা ১৯৯৭ সাল থেকে শুরু করেছিল এবং রাশিয়ার প্রতিবেশি দেশগুলোকে তারা ন্যাটোভুক্ত করা, মানে তারা সম্পূর্ণভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য বা জার্মানির অধীনে চলে যাওয়া। আর একটা বৃহৎ শক্তি রাশিয়ার মতো একটা দেশের বিপরীতমুখী একটা জোটে যাওয়া এবং সেই রাষ্ট্রটি যখন রাশিয়ার জন্য হুমকি হয়, তখন রাশিয়ার উপরে একধরনের নিরাপত্তার হুমকি তৈরি হয়। সেটি মোকাবিলার জন্য রুশরা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে। আর এটাই পুতিনের জনপ্রিয়তার পেছনে এটা একটা বড় কারণ।
আজকের পুতিনকে তৈরি করেছে আমেরিকানরাই। কারণ, এই ধরনের প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোকে সামরিক জোটের অন্তর্ভুক্ত করে রাশিয়ার সাথে ভয়ংকরভাবে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা তৈরি করেছে। ফলে রাশিয়ার জনগণ বাধ্য হয়ে পুতিনকে সমর্থন করছে। এভাবে জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। প্রকৃতপক্ষে ইউরোপ, ন্যাটো বা আমেরিকানদের পক্ষে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। তারা দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন ফর্মে। যেমন তারা অবরোধ আরোপ করেছে, অস্ত্র পাঠিয়েছে। কিন্তু তারা যে ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করবে, সেই অবস্থাটা একেবারেই কাম্য না। কেননা এখানে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর মূল স্বার্থ নিহিত নেই। এই দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ফ্রান্সের প্রতিবেশি রাষ্ট্র নয়। ইউক্রেন হচ্ছে রাশিয়ার প্রতিবেশি রাষ্ট্র।
এই সংকটকে পশ্চিমারা আগ্রাসন বলছে। অথচ এটা নতুন নয়। ইসরাইল, আমেরিকানরা বিভিন্ন সময় আক্রমণ করছে। ওটাকে কেউ আগ্রাসন বলেনি। আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করার সময় খুব কম লোকই বলেছে, এটা আগ্রাসন। আফগানিস্তানে যখন আমেরিকা ২০ বছর অবস্থান করেছে, তখন কেউ বলেনি ওটা আগ্রাসন। যদিও এ রকম সামরিক আক্রমণ করা ঠিক নয়।
রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যে ধরনের দ্বন্দ্ব বা সমস্যা আছে সেটা তারা মোকাবিলা করবে। সে ক্ষেত্রে ইউক্রেনের জোটবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা ছিল একটা ভয়াবহ পদক্ষেপ। ইউক্রেন গত ১০ বছর ধরে ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন শক্তির সঙ্গে একসুরে কথা বলে রাশিয়াকে অনেক হুমকি দিয়েছে। এই ধরনের সামরিক অভিযানের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান হবে না এবং এটা কোনোভাবে কাম্য নয়। কিন্তু এই বৃহৎ শক্তিগুলো তাদের স্বার্থে ইউক্রেনের মতো রাষ্ট্রগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করা, তাদের নিরাপত্তা, ভৌগোলিক অখণ্ডতাসহ অনেক কিছুর ওপরে আঘাত হানছে। এর পেছনে ইউক্রেন নিজেরাই দায়ী। কারণ, তারা যদি নিরপেক্ষতা বজায় রাখত তবে এই সমস্যাটা এই পর্যায়ে হতো না।
সুতরাং ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও বেশি করে অবরোধ আরোপ করবে। রাশিয়াকে বিভিন্নভাবে বয়কট করবে। কিন্তু এগুলো সাময়িক। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় কোনো দেশকে যদিও বিচ্ছিন্ন রাখার সুযোগ নেই। আর রাশিয়ার মতো একটা বিশাল রাষ্ট্র, যার সঙ্গে চীন ও ইরান আছে। এমনকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান মস্কো সফর করছে। এর ফলে পৃথিবীতে বিশাল একটা মেরুকরণের সম্ভাবনা আছে। তাতে করে বলা যায় যে পশ্চিমা দেশগুলো এতে লাভবান হবে না, বরং রাশিয়া ও চীনের এখান থেকে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
বিশ্বরাজনীতিতে একটা নতুন মেরুকরণ বা নতুন ধরনের সংঘাতের দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আবার সেখান থেকে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ আছে। আগে ইউক্রেনের পক্ষে রাশিয়ার প্রতিবেশি রাষ্ট্র হয়ে আরেকটি সামরিক জোটে যুক্ত হওয়াই এ পরিস্থিতির কারণ। কেননা ন্যাটো এমন একটি জোট, বলা হচ্ছে, এই জোটের কোনো সদস্যের প্রতি আক্রমণ করা হলে ন্যাটোর সকল সদস্যদের প্রতি আক্রমণের সমান। এটা হচ্ছে, স্নায়ুযুদ্ধকালের একটা জোট। এই জোটের সদস্য হওয়া মানেই হচ্ছে সেই রাষ্ট্র এই জোটের বাইরে যারা আছে তাদের জন্য একটা জীবন্ত আতঙ্ক। এই বাস্তবতার মধ্যে এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। এটা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। এখানে রাশিয়া আমেরিকা বা ইউরোপকে একটা বার্তা দিয়েছে। সেই বার্তাটা তারা ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে এবং সামনে ইউক্রেন শান্তিপূর্ণভাবে রাশিয়ার সাথে আলোচনা করে হয়তো যুদ্ধবিরতিতে যেতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সদস্য, সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)