স্মরণ
মুখর রাজপথে আজো শহীদ জিয়া
প্রায়ই একটি স্লোগান শুনি আমরা—দেশ গড়েছেন শহীদ জিয়া, নেত্রী মোদের খালেদা জিয়া। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের দেশ গড়ার স্বীকৃতিটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ, তিনি খুব বেশিদিন রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন এমন কিন্তু নয়। তবু বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির যে ধারা তিনি তৈরি করে দিয়েছিলেন, সেটিই আধুনিক বাংলাদেশের ভিত্তি হয়ে আছে আজ অবধি।
১৯৮১ সালের ৩০ মে, শুক্রবারের বৃষ্টিস্নাত ভোররাত, ঘাতকের বুলেটে একটি কিংবদন্তি অধ্যায়ের নিষ্ঠুর সমাপ্তি ঘটল সেদিন। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও উৎপানের রাজনীতির শুভসূচনা করলেন যিনি, একদলীয় শাসনের পরিবর্তে যিনি বহুদলীয় রাজনীতির মাঠ উন্মুক্ত করলেন, যিনি সংবাদপত্রের-মুক্তমতের স্বাধীনতা দিলেন তাকেই নির্মম হত্যার শিকার হতো হলো। সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী তাঁর গ্রন্থ ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য : স্বাধীনতার প্রথম দশক’-এ লেখেন, ‘ভোর ৪টার দিকে অফিসাররা অতর্কিতে সার্কিট হাউসে আক্রমণ করে। জুনিয়ার অফিসাররা নিজেরাই দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে প্রথমে সার্কিট হাউসে রকেট লাঞ্চার নিক্ষেপ করে। পরে এক গ্রুপ গুলি করতে করতে ঝড়ের বেগে সার্কিট হাউসে ঢুকে পড়ে। গুলির শব্দ শুনে জিয়া রুম থেকে বের হয়ে আসেন এবং কয়েকজন অফিসার তাঁকে ঘিরে দাঁড়ায়। ওই সময় লে. কর্নেল মতিউর রহমান মাতাল অবস্থায় টলতে টলতে ‘জিয়া কোথায়, জিয়া কোথায়’ বলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে আসে এবং পলকেই গজখানেক সামনে থেকে তার চায়নিজ স্টেনগানের এক ম্যাগাজিন (২৮টি) গুলি জিয়ার ওপর চালিয়ে দেন। অন্তত ২০টি বুলেট জিয়ার শরীরে বিদ্ধ হয় এবং পুরো শরীর ঝাঁজরা হয়ে যায়।’ পাশবিকতার একটি খণ্ডচিত্র এখানে পাওয়া যায়। জিয়াউর রহমান কী এমন ক্ষতি করেছিলেন তাদের যে শতাব্দীর নির্মম আঘাত তাকেই সহ্য করতে হলো?
দেশি-বিদেশি অপশক্তি তাতে প্রণোদনা জোগাল, কেউ প্রকাশ্যে, কেউ বা নেপথ্যে থেকে। যিনি ১৯৭১ সালে রণাঙ্গনে থেকে সরাসরি সম্মুখ সমরে লড়লেন এবং শেষপর্যন্ত বিজয় ছিনিয়ে আনলেন জাতির জন্য, তাঁর সঙ্গে এই ঘৃণ্য হিংসা চরিতার্থ না করলেই দেশ অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারত।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী একটি দেশে, একটি জাতির জন্য যে পুনর্গঠনমূলক কর্মসূচি প্রয়োজন হয়, তার সবটুকুই তিনি গ্রহণ করেছিলেন। জিয়াউর রহমানের রাজনীতিই ছিল মূলত মানবমুক্তির রাজনীতি, খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে ভূমিকা রাখা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মানুষকে কর্মমুখী হতে প্রেরণা জোগানো। তাঁর রাজনীতির মূল সুর ছিল ফসলের মাঠে সোনালি ধানের হাসি, সমৃদ্ধ-শক্তিশালী এক বাংলাদেশ। বিদেশ নির্ভরতা কমিয়ে এনে স্বনির্ভর অর্থনীতি মজবুতিকরণ ও সত্যিকার অর্থে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অধিকারকে পূর্ণতা দিয়েছিলেন তিনি। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাজনীতির বন্দিদশা ঘুচিয়ে সরব করে তুললেন মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইকে এবং এক ব্যক্তির শাসনের পরিবর্তে প্রতিনিধিত্বমূলক ও জবাবদিহিপূর্ণ ব্যবস্থা চালু করলেন। উৎসাহিত করলেন ভিন্নমত সহিষ্ণুতার সংস্কৃতিকে। দেশের সূর্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানজনক জীবনে ফিরিয়ে আনলেন।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান একটি কথা খুব শক্তভাবে বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশকে গড়তে হলে গ্রামগুলো গড়তে হবে এ জন্যই তিনি ছুটে বেড়ালেন দূর-সুদূরে, রাজনীতির কৌলীন্য প্রথা ঝেড়ে ফেলে নিজ হাতে কোদাল ধরলেন, খাল কেটে স্রোতস্বিনী নদীকে নিয়ে এলেন বাড়ির আঙিনায়, সবুজ দিগন্তের মাঝে, ধানক্ষেতের পাশে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে অনেকের ধারণা ছিল বিদেশিরা এসে আমাদের ভাগ্য গড়ে দেবে, তিনি এই উদ্ভট চিন্তাকে নাকচ করে দিয়ে বললেন, ‘মুক্তির জন্য কাজ করতে হবে, নিজেদের দেশ এবং ভাগ্যকে নিজেদের হাতেই গড়তে হবে।’ জাতীয়তাবাদী দলের ইশতেহারে দেখালেন সামগ্রিক অগ্রগতি এবং উন্নয়নের মৌলিক বিষয়বলি, অর্থাৎ উন্নয়ন ও উৎপাদনের উনিশ দফা। প্রগতি, উন্নয়ন, অগ্রগতি, সমৃদ্ধ সমাজচেতনাকে শহরের বাইরে ছড়িয়ে দিয়ে বোঝাতে চাইলেন, বাংলাদেশ শুধু শহরেই সীমাবদ্ধ নয়, এ দেশের বেশিরভাগ মানুষের বাস গ্রামে, গ্রামই এ দেশের প্রাণ। রাজনীতির হিংসাত্মক পথে না হেঁটে উদারতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বললেন তিনি। কিছুদিনের ভেতরে রাষ্ট্রের আমূল বদলে যেতে শুরু করল, সুষম বণ্টন, সুবিচার, মানবাধিকার, সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ ও সংস্কৃতি, পরমত সহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং অরাজকতার বিপরীতে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকল। তিনি বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে কখনো শত্রুজ্ঞান করেননি, বরং রাষ্ট্রের অপরিহার্য শক্তি হিসেবে প্রতিপন্ন করেছেন।
তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে আমৃত্যু বিশ্বাস রেখেছেন, আস্থা রেখেছেন বাংলাদেশের শক্তি-সামর্থ্য ও উদ্যমে, সকল প্রতিবেশী ও বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন সুসম্পর্ক। বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এই আস্থা ও বিশ্বাসের কথা শুনিয়েছেন তরুন সমাজকে। মেধাবী তরুণদের নিয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল প্রতিষ্ঠারও অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মেধাবী ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব গড়ে তোলা। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি প্রাণখুলে বলেছেন, প্রথম বাংলাদেশ আমার, শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ, আমার মরণ বাংলাদেশ। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আজ নেই এ কথা সত্য কিন্তু তাঁর আদর্শ, কর্ম, জীবনবোধ, তাঁর হাতে গড়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল আজো বাংলার জমিনে শক্তিশালী অবস্থান বজায় রেখেছে। গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে প্রয়োজন জিয়াউর রহমানের আদর্শে নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়ে রাজপথে নেমে আসা। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জোর দাবিই হোক এবারের শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাত বার্ষিকীর শপথ।
লেখক : সিনেট সদস্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।