বিশ্লেষণ
প্যারিস হামলার পূর্বাপর
দুনিয়ায় অশান্তি দিনের পর দিন জেঁকে বসছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যত অগ্রসর হচ্ছে ততই স্বজাতিকে হত্যার লীলায় মেতে উঠছে মানুষ। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। মানবজাতির উন্নয়নের মধ্যে এই দ্বান্দ্বিক বৈশিষ্ট্যের কথা অবশ্য জার্মান চিন্তাবিদ থিয়োডর অ্যাডর্নো ও ম্যাক্স হর্কহাইমাররা আগেই পেড়েছিলেন। সম্প্রতি ফ্রান্সে একযোগে সাত জায়গায় হামলার পর শতাধিক মানুষ নিহত হয়। আর এর পরই ব্রিটিশ পাকিস্তানি লেখক তারিক আলী এক মন্তব্য করেছেন নোক্তা আকারে।
সেই মন্তব্যে তারিক আলী বলেন, বিধ্বস্ত আরব অঞ্চলগুলোকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হলে তিনটি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এক, সৌদি আরবের রাজ পরিবারের ওপর থেকে পশ্চিমা আশীর্বাদ সরিয়ে নিতে হবে। দুই, আরব ও মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের দখলদারত্বের ইতি টানতে হবে। তিন, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনকে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে তাদের জনগণের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তারিক আলী বলেছেন, যত দিন না এই তিন পদক্ষেপ কার্যকরী হচ্ছে তত দিন নানা কিসিমের রাজনৈতিক উন্মাদ ও দানো বংশবৃদ্ধি করতেই থাকবে।
ওপরের এই কথাগুলো বলার মধ্য দিয়ে তারিক আলী প্যারিসে কিংবা পশ্চিম আরবের কোনো শহরে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে ওকালতি করছেন না। তাঁর এই কথার সঙ্গে আমিও একমত। সাধারণ মানুষ এখন উলু খাগড়ার মতো, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হচ্ছে, বা বলতে পারেন স্বার্থে স্বার্থে দ্বন্দ্ব, আর মারা পড়ছে অজস্র সাধারণ মানুষ। আরব দেশগুলোর মধ্যে ইরাক ও লিবিয়ার কথাই ধরুন। সেখানে গণতন্ত্র নেই বলে হামলা চালানো হলো। অথচ দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরব কিংবা কুয়েতে কোনো গণতন্ত্র নেই। কিন্তু তাতে কি যুক্তরাষ্ট্র বা তার দোসরদের মাথা ব্যথা আছে? নেই। কারণ সৌদি ও কুয়েতকে দিয়ে পশ্চিমাদের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে। কিন্তু যারাই পুরো আরবকে একত্র করে পশ্চিমাদের বিপক্ষে কিছু করার স্বপ্ন দেখেছে তাদেরই ছলেবলে, কৌশলে ধুলোর সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাদ্দাম হোসেন কিংবা মুয়াম্মার গাদ্দাফির মতোই অবস্থা হয়েছে তাদের। আর বাশার আল আসাদকে এখনো কুপোকাত করা যাচ্ছে না তার কারণ সেখানে আবার আরেক পরাশক্তির অহম জড়িত। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধ যেন নতুন করেই শুরু হলো এই সিরিয়াকে কেন্দ্র করে।
সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ গণতন্ত্রের চর্চা করেননি দীর্ঘদিন। এর বিরোধিতা করে মধ্যপন্থী এক গোষ্ঠী সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে সে দেশে। এই সুযোগটাই কাজে লাগাতে উঠে পড়ে লাগল পশ্চিমারা। তারা প্রস্তুত করল আইসিস বা আইএস (ইসলামিক স্টেট) নামের এক সংগঠনের সদস্যদের। সিরিয়ার আশপাশের দেশ- তুরস্ক ও জর্দান থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে পশ্চিমারা কয়েকশ আইএস জঙ্গীকে সিরিয়ায় ঢুকিয়ে দেয় শুধু বাশার আল আসাদকে উল্টে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি ইরান ও রাশিয়ার কারণে। তারপরও সিরিয়ার আকাশপথে নানারকম রসদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করে আসছিল আইএসকে। কিন্তু আইএস যখন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে উঠল, যখন হুমকি দিল তারা ইরাকও দখল করে নেবে তখন যেন কিছুটা টনক নড়ল পশ্চিমাদের। এরপর তারা শুরু করল উল্টোরথের যাত্রা। হামলা শুরু হলো তাদেরই প্রশিক্ষিত আইএস সদস্যদের ওপর। কিন্তু এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন আল কায়েদার মতো যুক্তরাষ্ট্রে নয়, হামলা চালাল ফ্রান্সে।
প্যারিসে এই সমন্বিত হামলার (১৪ নভেম্বর) এক মাস আগে থেকেই মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের হয়ে আইএসের ওপর বিমান হামলা চালায় ফ্রান্স। যদিও হামলার সময় ও লক্ষ্য নির্ধারণ করার স্বাধীনতা ফ্রান্সের আছে। বেশ ঢাকঢোল পিটিয়েই এই হামলা শুরু করা হয়। এখন প্যারিসে যখন আইএসের হামলা হলো তখন কি তারা ভুলে গেলেন, তাদের বন্ধুই একসময় এই আইএসকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল বাশারকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য? আফ্রিকার বিভিন্ন জায়গায় ও ইরাকে ফ্রান্সের প্রায় ১০ হাজার সেনা মোতায়েন রয়েছে। প্রশ্ন হলো কেন? বিশ্বজুড়ে এই যে আধিপত্য বিস্তারের খেলা, এই খেলা যত দিন না পর্যন্ত বন্ধ হবে তত দিন আসলে ওই পাল্টা হামলার আশঙ্কাও দূর হবে না। এটা কি ফরাসি নেতারা জানেন না? জানার পরও এ ধরনের খেলায় অংশ নেওয়ার আরেক অর্থ কি নিজের দেশের জনগণকেই হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া নয়? ফরাসিরা কেন সেই ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়কার মতো ভূমিকা অবলম্বন করছে না? তখন মার্কিন লেখক, বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীদের অনেকেই ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাই ফরাসি বুদ্ধিজীবীদের এখন বড় দায় ঘাড়ে এসে পড়েছে, তাদের সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। ফ্রান্স যেন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব থেকে বেরিয়ে আসে ও দুনিয়া জোড়া দখলদারত্বের রাজনীতি বন্ধ করে। তাদের যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হবে দুনিয়ার বহু দেশ দখলদারত্বের রাজনীতিতে না থেকেও সুখে শান্তিতে আছে।
সারা পৃথিবীতে এই আধিপত্য বিস্তারের খেলায় প্রাণ যাচ্ছে তো যাচ্ছেই- মালয়েশিয়া ও রাশিয়ার সাধারণ বিমানের যাত্রীদের প্রাণ গেল কিছুদিন আগে, প্রাণ যাচ্ছে সিরিয়া, আফগানিস্তানের নারী ও শিশুদের, প্রাণ যাচ্ছে ফিলিস্তিনে- প্রায় প্রতিদিনই, প্রাণ যাচ্ছে আফ্রিকা ও আরব দেশগুলোর বিভিন্ন শহরে। অবশ্য পশ্চিমাদের এই নয়া তরিকায় সাম্রাজ্য বিস্তারের খেলা জমে উঠছে সেসব দেশের অভ্যন্তরীণ ত্রুটির সুযোগেই। যেমন সিরিয়ায় যে বাশার ও তাঁর পিতা হাফেজ আল আসাদ ক্ষমতায় আছেন দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে- সেটাই দেশটিকে অস্থির করে তোলার সুযোগ তৈরি করেছে। আরব নেতৃত্বকেও সাবধান হতে হবে। আর তাদের ভেতরকার শিয়া ও সুন্নি বিভেদটাকেও আমলে নেওয়ার সময় এসেছে। এই বিভেদের কারণে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে- সেটারই সুযোগ নিচ্ছে বহির্শক্তি। বিধ্বস্ত ইরাকের অবস্থা দেখলে এই দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ধরা দেয়।
দুই নম্বর বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্তও সিরিয়া ফরাসিদের দখলে ছিল। কিন্তু ফ্রান্সের বুঝতে হবে সিরিয়া স্বাধীন, তাদের সার্বভৌমত্ব আছে। আইএস ধ্বংসের নামে তারা ওই দেশের মাটিতে হামলা চালাতে পারে না। তারপরও সিরিয়াদের নিয়ন্ত্রণের খায়েশ তারা ছাড়তে পারছে না। আধুনিক দুনিয়ার হিসাবটা একটু বদলালেও মূল বাসনা ওই একই আছে- দখল করা।
ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এরা প্রত্যেকেই বাশারের বাহিনী ও আইএসকে এখন নিজেদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। তারা চায় সিরিয়ায় মধ্যপন্থী বাশারবিরোধী যারা আছে তাদের সহায়তা করতে। এদের মধ্যে কুর্দি বিদ্রোহীরাও আছে। কৌশলগত কারণে বাশারের বাহিনীর সঙ্গে জোট বেঁধেছে কুর্দিরা, কারণ তাদের দুজনেরই শত্রু আবার আইএস। আইএসকে আরো অন্য জঙ্গি সংগঠনও সহ্য করতে পারে না। তো এই কুর্দিদের যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা দিলেও সিরিয়ার প্রতিবেশী তুরস্ক কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে। কারণ তুরস্ক চায় না তাদের প্রতিবেশী দেশে কুর্দিরা শক্তিশালী হয়ে উঠুক, এতে দেশের ভেতরকার কুর্দি সংগঠনের শক্তি বৃদ্ধি পাবে, সরকার চাপের মধ্যে পড়তে পারে। এই কারণেই কি প্যারিস হামলার এক মাস আগে তুরস্কের ভেতর কুর্দিদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যা করা হলো? সিরিয়ার ভেতরে কুর্দিদের ওপর যে হামলা চালানো হচ্ছিল সেটার প্রতিবাদ জানাচ্ছিল এই তুর্কি কুর্দিরা। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য অনেকেই আঙুল তুলছে তুর্কি সরকারের দিকেই। এই হামলায় মারা যায় ৯৫ জন। কৌতুকের বিষয় এই তুরস্ক কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। তো হিসাবটা দাঁড়াল, সিরিয়ায় কুর্দিদের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র হলেও, একই দেশ আবার শত্রু তুরস্কের বন্ধু।
সিরিয়া নামের এই পাশা খেলায় খেলোয়াড় হিসেবে একদিকে সৌদি আরব ও কাতার যেমন আছে, অন্যদিকে বাশারের সহায়তায় আছে ইরান। তেহরান তো নিজেদের সেনাবাহিনী দিয়েও সহায়তা করছে বাশারকে। লেবাননের হিজবুল্লাহও যুদ্ধ করছে বাশারের হয়ে। সিরিয়া লাগোয়া ইসরাইলেরও তাই ঘুম হারাম হওয়ার জোগাড়। কারণ এই সুযোগে না আবার ফিলিস্তিনের হিজবুল্লাহ আরো শক্তি অর্জন করে ফেলে। এজন্য ফিলিস্তিনে তারা সর্বক্ষণ এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রাখে, বিশেষ করে গাজা উপত্যকায়।
দুনিয়া জোড়া এই মারামারি ও হানাহানি বন্ধ হওয়ার যে তরিকা তারিক আলী দিয়েছেন তাঁর সঙ্গে আরো একটি বিষয় যোগ করে এই লেখা শেষ করব- সেটি হলো বিশ্বব্যাপী অস্ত্র তৈরি ও এর বেচাকেনার ব্যবসা বন্ধ করা। অন্য ব্যবসা বের করতে হবে। মারণাস্ত্রের ব্যবসা বন্ধ হলে আমার ধারণা এই খুনোখুনির অনেকাংশই কমে আসবে। সমন্বিতভাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া বেশ কঠিন, তারপরও চেষ্টা করতে হবে। জ্ঞান ও বিজ্ঞানে মানবজাতির উন্নয়ন প্রশংসনীয় কিন্তু তাদের হানাহানির ইতিহাসও সমানভাবে নিন্দনীয়।
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক