যশোর মুক্ত দিবস
বীর প্রতীক রকেট জলিলের বীরগাথা
‘সেই অপারেশনে কতজন মারা গেছিল, গুনতে পারিনি। কিন্তু একটা খেজুরগাছের মাথায় দুই পাক সেনার মাথাবিহীন দুটো লাশ ক্রস চিহ্নের মতো ঝুলে আছে।’
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অনেক অপারেশনের একটির বর্ণনা দিতে গিয়ে কথাগুলো বলছিলেন রকেট জলিল। রকেট জলিল মানে আমাদের বীর প্রতীক আবদুল জলিল। গোটা যশোরে যাঁর পরিচিতি রকেট জলিল হিসেবেই। মহান মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর কাছে সাক্ষাৎ এক আতঙ্কের নাম! তাঁর জবানিতে শুনি সেদিনকার ঘটনা :
‘জুলাইয়ের প্রথম দিকের ঘটনা। যশোরের ঝিকরগাছার দোসতিনা প্রাইমারি স্কুলের মাঠে ক্যাম্প করেছে পাকিস্তানিরা। পাশে ছুটিপুরে তাদের হেডকোয়ার্টার। তখন বর্ষাকাল। ক্যাম্পের সেনারা প্রতিদিন বদলি হয়। সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১০টা নাগাদ তারা ক্যাম্প বদল করে। আমরা ২০ জনের একটি টিম নিয়ে বড় একটি অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিই মধুখালীর শালবাগান এলাকায়।’
রাত ৪টার দিকে তিনি, আবদুস সাত্তার, গোলাম মোরশেদ, রফিকুল ইসলাম, চাপাতলার সাত্তারসহ ২০ জন সেখানে অ্যামবুশ করেন। এরই মধ্যে রাস্তায় ১২টি অ্যান্টি-পারসোনাল জাম্পিং মাইন পুঁতে রাখা হয়। খুবই দক্ষতার সঙ্গে কাজটি করেন তিনি।
সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে সেনারা স্থান বদল করে। কিন্তু যথাসময়ে পাকিস্তানি সেনারা কেউ আসছে না। বেলা ১১টার দিকে রকেট জলিল রেকি করতে বের হন। টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। মাথায় টোকা, হাতে নিড়েন আর কাঁস্তে। হঠাৎই আবির্ভূত হয় পাকিস্তানিরা!
জিজ্ঞেস করে, ‘তুম মুক্তি?’ জবাব দেন, ‘নেহি।’ এর পর সেনারা তাঁকে আটক করে নিয়ে যেতে থাকে দোসতিনার মধ্য দিয়ে। বেশ বিচলিত হন রকেট জলিল, কলেমা পড়েন; ভাবেন, রাজাকাররা যদি দেখিয়ে দেয়, তবেই শেষ!
মাথায় একটা গুলির বাক্স দিয়ে তাঁকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেনারা। কিছুদূর যাওয়ার পর কাদামাটিতে ইচ্ছা করেই পড়ে যান। ভাবেন, যদি অসুস্থ মনে করে তাঁকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু বিধি বাম! উল্টো লাথি মেরে তাঁকে জোর করে উঠিয়ে আবারো মাথায় বাক্সটি তুলে দেয়। এভাবে পৌঁছে যান দোসতিনার মোমিন মাস্টারের কাঁঠালবাগানে। সেখানে দুজন সেনার উপস্থিতিতে গাতি দিয়ে তাকে মরচে (বাংকার) খুঁড়তে বলে। দু-এক কোপ দেওয়ার পর জলিল দেখেন, পাকিস্তানি সেনা দুজন গাছের শেকড়ের পরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে দুদিকে মুখ ঘুরিয়ে। এই সুযোগ! আস্তে আস্তে চলে যান তাদের কাছে। গাতি দিয়ে মাথা বরাবর কোপ! দুই ভাগ হয়ে গেল নিমেষে। শব্দে অপরজন সামনে ফিরতেই সেটাকেও...। মাথার ঘিলু-রক্তের ছোপ ছিটকে মুখে লাগে। দুটি চায়নিজ রাইফেল নিয়ে ভোঁ-দৌড় দেন।
পরদিন সেই জায়গায় আবারো ১২টি মাইন স্থাপন করেন জলিল। সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ সেনাসদস্যরা সেখানে হল্ট করায় বাহিনীকে। তিন শতাধিক সৈন্য কাদামাটিতে, অস্ত্র কাঁধে সতর্ক অবস্থায়।
রকেট জলিল বলেন, ‘আমরা ২০ জনের মতো অ্যামবুশে। একজনের দায়িত্ব ছিল মাইনের সঙ্গে যে শক্ত সুতো বাঁধা, সেটা টান দেওয়ার। আর্মিদের উপস্থিতিতে ফিরে দেখি সে নেই; পালিয়েছে আরো পাঁচ-ছয়জন। আমি বাংকারে, এসএলআর হাতে। এখান থেকে পালানো সম্ভব নয়। ইয়া আলী বলে সুতো ধরে দিই টান। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয় মাইনগুলো। এসএলআরটি নিয়ে দাঁড়িয়ে ব্রাশফায়ার করি। অপর সঙ্গীরাও ফায়ার করছেন। ফায়ার করতে করতে আমরা পেছাচ্ছি। লাশ পড়ছে কাদার মধ্যে।’
কত সৈন্য মারা গেছে, দেখেননি। কিন্তু মাইন বিস্ফোরণের পর দেখতে পান, একটি খেজুরগাছের ডালে মাথাবিহীন দুই সেনা ক্রস চিহ্নের মতো ঝুলে রয়েছে।
জলিল বলেন, ‘গরুর গাড়িতে করে লাশগুলো নিয়ে যাওয়া হয় ঝিকরগাছা থানায়। যারা নিয়ে গেছিল, তারা লাশ গুনে জানিয়েছিল ৩২; পরদিন কপোতাক্ষের পানিতে পাওয়া যায় আরো ছয়টি লাশ।’
‘রকেট জলিল আমার খেতাব’ বলেন এই বীর প্রতীক। একদিনে চার-পাঁচ স্থানে অপারেশনে নেতৃত্ব দিতেন। অল্পসময়ে দ্রুত কাজ করার কারণেই খানরা সে সময় বলত, ‘রকেট হ্যায় না কিয়া হ্যায়!’
আবদুল জলিল ১৯৬৮ সালে ইপিআরে যোগ দেন, সিপাহি পদে।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উজ্জীবিত এবং পরে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন ইপিআরের রাজশাহী অঞ্চলে কর্মরত এই জওয়ান। ২৮ মার্চ তিনিসহ চারজন চারটি রাইফেল নিয়ে রাজশাহী থেকে যশোরে এবং সেই দিনই বেনাপোলে ক্যাম্পে গিয়ে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার কথা বলেন।
রাতেই মার্চ করেন যশোরের চাঁচড়া ক্যাম্পে। ৮ নম্বর সেক্টরে মেজর আবু মঞ্জুরের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশগ্রহণ। রকেট জলিল ছিলেন টুআইসি ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার তত্ত্বাবধানে।
যুদ্ধ চলাকালে জুলাই মাসে ঝিকরগাছার গঙ্গাধরপুর-দোসতিনায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন রকেট জলিল। গুলিটি বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচে বিদ্ধ হয়, নিহত হয় চার পাকিস্তানি সেনা।
ভারতের বনগাঁ হাসপাতাল থেকে গুলি বের করে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় নৌপথে তিনি চলে আসেন। এক রাত ছিলেন, কেননা তাঁর অনুপস্থিতিতে অন্যরা হতাশ হতেন।
ঝিকরগাছার বনমান্দার এলাকায় দ্বীপের মতো একটা আস্তানাই ছিল রাধানগর ক্যাম্প। চারপাশে পানি, নৌকায় যাতায়াত করতে হতো।
১৯৯৬ সালে ‘বীর প্রতীক’ পদক দেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মুক্তিযোদ্ধা ও বীর প্রতীক ভাতা এবং আড়াই বিঘা জমি থেকে পাওয়া ফসল থেকেই সংসার চলছে জলিলের। ২০১১ সালে হার্টে দুটো রিং পরানো হয়; আছে ডায়াবেটিস আর উচ্চ রক্তচাপ। স্ত্রী হালিমা খাতুন, তিন ছেলে আর চার মেয়ে বর্তমান। ছেলেরা সবাই দেশের বাইরে থাকে; মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন।
যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে স্বাগত জানান রকেট জলিল। বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আরো আগেই এদের বিচার হতো। বিচার প্রক্রিয়ায় কোনো ভুল নেই। যাদের বিচার করা হচ্ছে, তারা সবাই অপরাধী।’
‘যে উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম, তা বাস্তবায়ন হচ্ছে। আগে বাঙালি মূর্খ ছিল, বুঝত না; এখন অনেক সচেতন। নতুন করে জঙ্গি আর আইএসের নামে যে তৎপরতা, তা-ও কঠোর হস্তে দমন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’, দৃঢ়তার সঙ্গে জানান জলিল।
সরকারের কাছে বীর প্রতীক আবদুল জলিলের একটিই চাওয়া, যারা রাষ্ট্রদ্রোহী, তাদের বিচার হোক। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করুক সরকার, যেন তারা রাষ্ট্রবিরোধী লোকজনকে ধরে আইনে সোপর্দ করে।