জেন-জি প্রজন্মের বিক্ষোভে ফুঁসে উঠল মাদাগাস্কার

মাদাগাস্কার বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ। আফ্রিকার দক্ষিণ–পূর্ব উপকূলের বাইরে অবস্থিত এ দ্বীপ রাষ্ট্রটি ভৌগোলিক বৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হলেও সামাজিক অর্থনৈতিক সূচকে পিছিয়ে রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে দেশটির প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। এর মধ্যে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। বিদ্যুৎ সুবিধা আছে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ মানুষের, তাও অনির্ভরযোগ্য প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। পানি সরবরাহেও একই সংকট। রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জিরামা প্রায় প্রতিদিন বিভ্রাটের ঘোষণা দেয়। ফলে নাগরিক জীবনে অস্থিরতা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
বিক্ষোভের সূচনা: জেন–জি প্রজন্মের অগ্রণী ভূমিকা
চলতি মাসের সেপ্টেম্বরে তরুণদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া বিক্ষোভ কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও মৌলিক সেবা সংকট থেকে জমা হওয়া ক্ষোভ একসময় বিস্ফোরণ ঘটায়।
বিশেষ দিক হলো বিক্ষোভকারীদের অধিকাংশই তরুণ, বিশেষত জেনারেশন জেড । এ প্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভ্যস্ত, বৈশ্বিক রাজনৈতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে সচেতন এবং পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় সাহসী। তারা স্লোগান তুলেছে: “আমরা বাঁচতে চাই, টিকে থাকতে নয়।”
এ স্লোগান শুধু জীবনধারণের দাবি নয়, বরং মর্যাদাপূর্ণ জীবনের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতীক।
বৈশ্বিক সংযোগ ও অনুপ্রেরণা
মাদাগাস্কারের তরুণরা কেবল স্থানীয় সংকট নিয়েই বিক্ষোভে নামেনি, তারা বৈশ্বিক আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে।
নেপালে সম্প্রতি তরুণ নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের ফলে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
কেনিয়া ও মরক্কোতেও তরুণ প্রজন্ম সরকারবিরোধী প্রতিবাদে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।
এই ঘটনাগুলো দেখিয়েছে যে, তরুণরা যখন ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোকে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। আন্তানানারিভোর বিক্ষোভকারীরা নেপালের পতাকা ব্যবহার করেছেন প্রতীক হিসেবে, যা বৈশ্বিক তরুণ আন্দোলনের প্রতি সংহতির ইঙ্গিত দেয়।
সহিংসতার গতিপ্রকৃতি: রাষ্ট্র ও জনগণের সংঘর্ষ
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর জানিয়েছে, আন্দোলনে এখন পর্যন্ত অন্তত ২২ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছে। পুলিশের রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস এবং সরাসরি গুলি চালানোর অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া কারফিউ জারি করা হয়, সুপারমার্কেট ও ব্যাংকে লুটপাট, রাজনীতিবিদদের বাড়িতে হামলা এসবই পরিস্থিতিকে জটিল করেছে।
অন্যদিকে, সরকারের দাবি, নিহতের সংখ্যা নিয়ে জাতিসংঘের তথ্য “ভুল বা গুজবনির্ভর”। এ দ্বন্দ্ব প্রমাণ করে, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যে আস্থার সংকটও রয়েছে।
নেতৃত্বের দায় ও রাজনৈতিক প্রভাব
প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনা ২০২৩ সালে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত হন। কিন্তু এবারকার বিক্ষোভ তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে তিনি সরকারের ব্যর্থতার জন্য ক্ষমা চান এবং সরকার ভেঙে দেন। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তা ও তরুণদের সঙ্গে নতুন যোগাযোগমাধ্যম গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তবে প্রশ্ন হলো, সরকার ভেঙে দেওয়া কি সমস্যার মূল সমাধান? বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি মূলত পরিস্থিতি শান্ত করার একটি অস্থায়ী কৌশল। কারণ কাঠামোগত দুর্নীতি, জিরামার অদক্ষতা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য সমাধান না হলে সংকট আবারও দেখা দেবে।
জেন–জি প্রজন্মের রাজনীতিকরণ
এই আন্দোলনের মূল বার্তা হলো রাজনৈতিক অঙ্গনে তরুণদের ভূমিকা উপেক্ষা করা যাবে না। আগে মাদাগাস্কারের রাজনীতি ছিল প্রবীণ নেতৃত্ব ও ক্ষমতাসীন অভিজাত গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু নতুন প্রজন্ম দেখিয়েছে, তারা শুধু সামাজিক মাধ্যমে নয়, রাস্তায় নেমেও পরিবর্তন আনতে পারে।
যদি এই শক্তিকে গঠনমূলক রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ দেওয়া যায়, তবে তারা ভবিষ্যতের রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে পরিণত হতে পারে। কিন্তু যদি আন্দোলন সহিংসতা ও ভাঙচুরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তা তাদের সম্ভাবনাকে ক্ষুণ্ণ করবে।
মাদাগাস্কারের ঘটনাটি প্রমাণ করছে, ২১ শতকের তরুণেরা আর চুপচাপ থাকবে না। ডিজিটাল যুগের সংযোগ তাদের আরও সচেতন ও সংগঠিত করেছে। একটি দেশের বিক্ষোভ সহজেই অন্য দেশে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে।
এ থেকে বোঝা যায় অর্থনৈতিক বৈষম্য, মৌলিক সেবা সংকট ও দুর্নীতি যদি চলতে থাকে, তবে আফ্রিকা থেকে এশিয়া, লাতিন আমেরিকা সবখানেই তরুণদের বিক্ষোভ আগামী দিনের বড় রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠবে।