দৃষ্টিপাত
কোরবানির ঈদে লবণ ও চামড়ার মূল্য

লবণ একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য। সেইসঙ্গে এটি একটি প্রাকৃতিক সম্পদ, রাসায়নিক ও শিল্পজাত পণ্যও। সমুদ্রের নোনাজলে থাকা এ সম্পদ বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে লবণে পরিণত করা হয়। শিল্পেই এর বেশি ব্যবহার। তবে তার সামান্যই ভোজ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। শিল্পে যা ব্যবহার করা হয়, তা সাধারণত অপরিশোধিত এবং ভোজ্য হিসেবে যা ব্যবহৃত তার বেশিরভাগই পরিশোধিত। কাজেই পরিশোধিত লবণের চেয়ে অপরিশোধিত লবণের মূল্য বাজারে অনেক কম থাকে। আর কোরবানি ঈদে কাঁচা চামড়া সংরক্ষণের জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান হলো অপরিশোধিত লবণ। সে জন্য কোরবানির ঈদ এলেই একশ্রেণির অতি মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা অন্যায় ও অযাচিতভাবে বিভিন্ন অগ্রহণযোগ্য অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন আইটেমের মূল্য বাড়িয়ে দেয়।
কোরবানির ঈদে সেই অপরিহার্য অন্যতম উপাদানটি হলো অপরিশোধিত লবণ। যেমন গত বছর (২০১৫) পর্যন্ত প্রতি কেজি অপরিশোধিত লবণের পাইকারি মূল্য ছিল মাত্র পাঁচ থেকে আট টাকা। আর পরিশোধিত প্রতি কেজি লবণের পাইকারি মূল্য ছিল মাত্র ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ টাকা, যা সব ধরনের ক্রেতা ও ব্যবহারকারীর নাগালের মধ্যেই ছিল বলে মনে করছেন এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী ও ব্যবহারকারীরা। কিন্তু সমস্যা হয়েছে এবারে (২০১৬)। রমজানের ঈদের পর থেকেই উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাড়তে থাকে লবণের দাম। আর বাড়তে বাড়তে এখন সর্বশেষ তা আগের বছরের দ্বিগুণ পরিমাণে এসে ঠেকেছে। বর্তমানে প্রতি কেজি অপরিশোধিত লবণের মূল্য এখন পাইকারি বাজারে ১৫ থেকে ১৯ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর পরিশোধিত প্রতি কেজি লবণ এখন কমপক্ষে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এখানে চামড়া ব্যবসায়ীরা একে সামনে নিয়ে এসে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে চামড়ার প্রতি বর্গফুটে ধার্যমূল্য কমানোর পাঁয়তারা করছেন। কারণ, কোরবানির ঈদে যে পরিমাণ চামড়া উৎপাদিত হয় তা সারা বছরের মোট উৎপাদন ও চাহিদার শতকরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগ। কাজেই সেই চামড়ার প্রতি সবারই একটু অন্য রকম দৃষ্টি পরিলক্ষিত হয়। চামড়ার মূল্য নির্ধারণে শুরু হয় বিভিন্ন তৎপরতা ও অপতৎপরতা। চামড়ার মূল্য হলো আসলে গরিবের হক। কারণ, ঈদে এ চামড়ার মূল্য গরিব প্রতিবেশীদের মধ্যে কিংবা কোনো মসজিদ-মাদ্রসা-এতিমখানায় সদ্গাহ হিসেবে দান করে দেওয়া হয়। সে জন্য এর কমবেশি মূল্যপ্রাপ্তির সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচনেরও একটি সম্পর্ক রয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনেক চাপাচাপির পর এবার শেষ পর্যন্ত ঈদের মাত্র চার দিন আগে চামড়া ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তিনটি সংগঠন একসঙ্গে মিলে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে দিতে এক প্রকার বাধ্য হয়েছে। সেখানে ঢাকা শহরের জন্য লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট বড় পশুর (গরু, মহিষ) চামড়ার ক্রয়মূল্য ৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে তা ৪০ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ গত বছর এ মূল্য ছিল যথাক্রমে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা এবং ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। আবার ছোট পশুর মধ্যে (খাসি, ভেড়া, বকরি) লবণসহ প্রতি বর্গফুট ২০ টাকা এবং ১৫ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানেও গত বছর এ মূল্য প্রতি বর্গফুটে পাঁচ টাকা বেশি ছিল। সরকারের চাপে পড়ে মূল্য নির্ধারণকারী সংগঠন তিনটি হচ্ছে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়ার এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন ইত্যাদি।
আমরা সাধারণ অর্থনৈতিক পরিভাষায় বুঝতে পারি, প্রতি বছরই এসব জিনিসের দাম বাড়ে। কিন্তু গরিবের হক বলে খ্যাত এ চামড়ার মূল্য কয়েক বছর ধরে ক্রমাগতভাবে কমতে কমতে যাচ্ছে। এর কী কারণ থাকতে পারে, সেটি বিশ্লেষণ করে বের করা দরকার। যেখানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রতিটি দেশে চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে এবং বাড়ছে তাদের দামও। তাহলে কেন বাংলাদেশের চামড়ার মূল্য ফি বছর কমে যাবে! ঈদের দিনে চামড়া কেনাবেচা থেকে শুরু করে প্রতিটি কাজেই যেন চামড়ার মূল্য নিয়ে একটি ঠকবাজি শুরু হয়ে যায়। সেখানে দালাল-ফড়িয়া, মধ্যস্বত্বভোগী এবং অপেশাদার অনেকে চামড়া ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে এ শিল্পকে আজ প্রশ্নের সম্মুখীন করে তুলছে ক্রমে। আর এবারে লবণের মূল্য সেখানে আরেকটি ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবেই দেখা দিচ্ছে। অথচ চামড়াশিল্পে ব্যবহারের জন্য মাত্র ৪০ হাজার টন লবণ প্রয়োজন পড়ে। সে জন্য সরকার অবশ্য লবণ সমস্যা সমাধানের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে দেড় লক্ষাধিক টন লবণ আমদানির জন্য এলসি খোলার অনুমতি প্রদান করেছে। আবার চামড়ার মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে যদি মূল্য খুব বেশি কমিয়ে ফেলা হয়, তবে তা আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কাজেই একদিকে লবণের মূল্য ও অন্যদিকে চামড়ার মূল্য, তার সঙ্গে গরিবের হক ইত্যাদি সবকটিকেই বিবেচনায় নিয়ে একটি সমাধানের পথে এগোতে হবে—এখন এবং আগামী দিনে।
লেখক : কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।