দ্বিতীয় বিতর্ক এবং ‘বিপজ্জনক’ ট্রাম্প
জমজমাট হয়ে উঠছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। গত ৯ অক্টোবর ২০১৬ রোববার অনুষ্ঠিত হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী বিতর্ক। বিতর্কটি যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় রাত ৯টা ৩০ মিনিটে শুরু হয়ে ৯০ মিনিট শেষে সমাপ্ত ঘোষিত হয়। কোটি কোটি বিশ্ববাসীর সঙ্গে বাংলাদেশের অগণিত দর্শক-শ্রোতা গত সোমবার সকালে বিতর্কটি উপভোগ করে। যেহেতু বিতর্কটি ছিল দুই প্রেসিডেন্ট পদ প্রার্থীর জন্য ‘ভাগ্য পরীক্ষা’ সেহেতু গণমাধ্যম, গবেষক, প্রচারকর্মী এবং তাৎক্ষণিক বিশ্লেষণকারীরা নিবিষ্ট ছিলেন জনমত সমীক্ষায়। রিপাবলিকানদের হতাশ করে এবারও ধরাশায়ী হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে প্রার্থিতা হারানোর আশঙ্কা থেকে রক্ষা করতে পেরেছেন নিজেকে। বিতর্কটি সমসাময়িক ইতিহাসের সবচেয়ে ‘নোংরা বিতর্ক’ বলে অভিহিত হয়েছে।
প্রার্থী দুজনই একে অপরকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন। গালমন্দের ব্যাপারে এগিয়ে ছিলেন ট্রাম্প। তিনি নির্বাচিত হলে হিলারিকে জেলে পাঠাবেন বলে ভীতি প্রদর্শন করেন। ট্রাম্প হিলারিকে শয়তান, মিথ্যাবাদী বলে গালি দেন। আর উভয় উভয়কে প্রেসিডেন্ট হওয়ার অযোগ্য বলে মনে করেন। প্রথম বিতর্কের পর তাঁদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। দ্বিতীয় বিতর্কের শুরুতে একে অপরের সঙ্গে সৌজন্য মূলক করমর্দন করেননি। উল্লেখ্য যে, এই বিতর্কে দু-একদিন আগে নারীদের সম্পর্কে ট্রাম্পের অশ্লীল আপত্তিকর মন্তব্য প্রকাশিত হয়। রিপাবলিকান পার্টির নামি-দামি লোকেরা তাঁর প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। নারীঘটিত বিষয়টি বিতর্কে উত্থাপিত হলে ট্রাম্প বেসামাল হয়ে পড়তে পারেন এবং প্রার্থিতা হারাতে পারেন- এ রকম আশঙ্কা ছিল অনেকের। আর তা হলে হিলারির জন্য সম্ভাব্য প্রার্থী (বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ প্রার্থী) মাইক পেন্স আরো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে উঠবেন, এই আশঙ্কায় হিলারি কৌশলী ছিলেন বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা।
উল্লেখ্য যে, এ ধরনের বিতর্ক মার্কিন সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এভাবেই প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে তাঁর যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। এটি হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫৮তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আর যিনি নির্বাচিত হবেন, তিনি ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত হবেন।
মার্কিন নির্বাচন ব্যবস্থায় বিতর্ক একটি চমৎকার বিষয়। এতে প্রার্থীদের যোগ্যতা নিরূপণের যেমন সুযোগ ঘটে, তেমনি জনজবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এর আগে ২৬ সেপ্টেম্বর প্রথম বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। ইতিহাস-ঐতিহ্য অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রেসিডেন্ট পদ প্রার্থীরা তিন-চারটি জাতীয় বিতর্কে অংশ নিয়ে থাকেন। অতীতে এ নিয়ম ছিল না। ১৯৬০ সাল থেকে নিয়মিত এ বিতর্ক চলে আসছে। ১৯৮৭ সাল থেকে নতুন আঙ্গিকে, নতুন ব্যবস্থাপনায় বিতর্কটি আয়োজিত হচ্ছে। এ বিতর্কগুলো এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যে, গোটা জাতি উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং উপলব্ধি দ্বারা আলোড়িত হয়। একক বৈশ্বিক পরাশক্তি হওয়ার কারণে পৃথিবীব্যাপী এসব বিতর্ক গুরুত্বের সঙ্গে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়। প্রথম বিতর্কে জনমতে হিলারি ক্লিনটন এগিয়ে ছিলেন। দ্বিতীয় বিতর্কেও তিনি এগিয়ে থাকবেন এমনটি নাও হতে পারে- এ রকম আশঙ্কা ছিল অনেকের। এ ছাড়া ডোনান্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় বিতর্কে জয়ী হওয়ার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়ে ছিল। তবে কোনো কিছুই কাজে আসেনি দ্বিতীয় বিতর্কে। বিগত দেড় বছরের প্রচারণায় ট্রাম্প অস্বাভাবিক আচরণ করেছেন বলে প্রচার রয়েছে। শুধু তাই নয় বিশ্লেষকরা বলছেন, দৈব দুর্ঘটনাক্রমে তিনি যদি সত্যি সত্যিই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তাহলে তা হবে বিপজ্জনক।
মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী একটি বিধিবদ্ধ সময়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১২ সালে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য বারাক ওবামা নির্বাচিত হন। একজন ব্যক্তি যাতে ক্ষমতার সর্বেসর্বা হয়ে না ওঠেন। সে জন্য মার্কিন সংবিধানের ২২তম সংশোধনী অনুযায়ী একজন প্রেসিডেন্ট দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট থাকতে পারেন না। আগামী ৮ নভেম্বর, ২০১৬ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য মার্কিন জনগণ ভোট প্রদান করবেন। নির্বাচন প্রক্রিয়া পরোক্ষ এবং জটিল। দলীয় মনোনয়ন পাওয়াও সহজ সাধ্য নয়। যা হোক দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং ঐতিহ্য অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুটো প্রধান দল ডেমোক্রাট এবং রিপাবলিকান পার্টি তাদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতা চূড়ান্ত করেছে। সাবেক ফাস্ট লেডি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী (Secretary of State) হিলারি ক্লিনটন ডেমোক্রাট দলের প্রার্থী নির্বাচিত হন। অপরদিকে রিপাবলিকান দল চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ধনকুবের ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তাদের প্রার্থী মনোনয়ন করে। এই বছরটি তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যস্ত ছিল। এখন তারা তাদের শেষ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হচ্ছে। ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা টিভি বিতর্কে অবতীর্ণ হন। মার্কিন জনগণের কাছে এটি একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় বিষয়। সব টেলিভিশন এই বিতর্ক সরাসরি সম্প্রচার করে। কোটি কোটি মার্কিন জনগণ তো বটেই, গোটা বিশ্ব এ বিতর্ক উপভোগ করে। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে দেখা যায়, গতানুগতিকভাবে বিভাজিত ‘ভোট সাম্রাজ্যে’ এই বিতর্ক খুব কমই প্রভাব ফেলে। তারপরও বিতর্ক দেখে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের মেধা মনন, শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং যোগ্যতা-অভিজ্ঞতা সম্পর্কে হিসাব-নিকাশ নিতে চায় মার্কিন নাগরিকরা। বছরের এ সময়টা অর্থাৎ ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গোটা মার্কিন গণমাধ্যম বিতর্ক নিয়ে সরব থাকবে। এরই মধ্যে প্রথম বিতর্কটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ মার্কিন সময় রাত ৯টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত। মোট ৯০ মিনিটে বিতর্কটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটি নিউইয়র্কের হফস্ট্রা ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত হয়। এতে সঞ্চালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এনবিসি টেলিভিশনের উপস্থাপক লেস্টার হল্ট।
আরো দু-তিনটি বিতর্ক একই সময়ে বিভিন্ন তারিখে অনুষ্ঠিত হবে। প্রেসিডেন্ট বিতর্ক অনুষ্ঠানের জন্য গঠিত একটি সংগঠন (The Commission on Presidential Debates-CPD) এসব বিতর্ক পরিচালনা করে থাকে। নতুন করে ১৯৮৭ সালে এ সংগঠনটি গঠিত হয়। সিপিডির তত্ত্বাবধানে আরো দুটি বিতর্ক অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রতিদ্বন্দ্বীদের মাঝে আরেকটি বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছে। একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে সিপিডি প্রেসিডেন্ট বিতর্কের ব্যবস্থাপনা করে থাকে। এরা শুধু প্রধান দুই দল থেকে যে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে বিতর্কে আহ্বান জানায় তা নয়। প্রার্থী তিনি যে দলেরই হোন না কেন, তিনি যদি ২৭০টি নির্বাচকমণ্ডলীর ভোট পান এবং তাঁর ভোটের পরিসংখ্যান যদি হয় কমপক্ষে ১৫%, অন্তত পাঁচটি নির্ধারিত জাতীয় ভিত্তিতে গৃহীত ভোটে, তাহলে তাকে বিতর্কে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। এবার চারজন প্রার্থী ন্যূনতম নির্বাচনী ভোট লাভ করেছেন। কিন্তু অন্য দুজন প্রার্থী গড়পড়তা ভোট কম পাওয়ায় তাঁদের বিতর্কে ডাকা যায়নি। যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁরা হলেন গ্রীন পার্টির নমিনি জিল স্টেইন এবং লিবারেটারিয়ান দলপ্রার্থী গ্যারি জনসন। সিপিডি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এ বিতর্ক আয়োজন করে থাকে। নির্ধারিত সময়কে তারা ১৫×৬= ৯০ স্লটে ভাগ করে থাকে। প্রতিটি স্লটে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের অবতারণা করা হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনার সম্পূর্ণ ক্ষমতা থাকে সঞ্চালকের। সমবেত জনগণের প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ রাখা হয় না। তবে এর ব্যতিক্রমও হতে পারে। আয়োজকরা নামিদামি ব্যক্তিদের সঞ্চালক হিসেবে আমন্ত্রণ জানায়।
আর একটি সংগঠন (The Free and Equal Elections Foundation) একটি অতিরিক্ত প্রেসিডেন্ট বিতর্ক পৃথকভাবে আয়োজন করে থাকে। এরা কোনো বাধ্যবাধকতা না রেখে সব প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে বিতর্কে অংশগ্রহণের আহ্বান জানায়। এবারও তারা সব প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তবে সেখানে হিলারি এবং ট্রাম্প নাও যেতে পারেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থীর যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে অবশ্যই জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিক হতে হবে। তার বয়স হতে হবে কমপক্ষে ৩৫ বছর। একনাগাড়ে ১৪ বছর বসবাসরত থাকতে হবে যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দলীয় ব্যবস্থাপনা দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র হওয়ার কারণে সাধারণত প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা যে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন প্রার্থনা করে থাকেন। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে ক্রমান্বয়ে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা বিকশিত হয়েছে। নির্দিষ্ট দল প্রার্থীদের মনোনয়ন দিতে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের মতামত গ্রহণ করে। সেখানেও পরোক্ষভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় মতামতের সমন্বয় ঘটতে দেখা যায়। সেটাকে তারা বলে প্রাথমিক নির্বাচন। আইন অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষ হবে ২০ জানুয়ারি ২০১৭। এর আগেই অর্থাৎ ৮ নভেম্বর ২০১৬ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়ে যাবে। নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা, রাজনৈতিক সুস্থিতি এবং দুই প্রেসিডেন্টকে পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও অনুধাবনের জন্য এই মধ্যবর্তী সময়টি দেওয়া হয়। সাধারণত একই স্টেট থেকে দুজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে না। তবে এবারই প্রথম উভয় প্রার্থীই নিউইয়র্ক থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ঘোষিত সূচি অনুযায়ী বিগত ৯ অক্টোবর দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সিএনএন গৃহীত এক তাৎক্ষণিক জরিপে বলা হয়, ৫৭ শতাংশ দর্শক মনে করেন, এই বিতর্কে হিলারি জয়ী হয়েছেন। অন্যদিকে ৩৪ শতাংশ দর্শক বিজয়ের মাল্য দেন ডোনাল্ট ট্রাম্পকে। তিনি প্রত্যাশার চেয়ে ভালো করেছেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। অনেকের আশঙ্কা ছিল, প্রথম বিতর্কের ধারাবাহিকতায় ট্রাম্প সবকিছু গণ্ডগোল করে ফেলবেন। অধিকাংশ ভাষ্যকার মনে করেন, দ্বিতীয় বিতর্কে ট্রাম্প তাঁর ভোট না বাড়াতে পারলেও নিজের সর্বনাশ ঠেকাতে পেরেছেন। ভাষ্যকাররা আরো বলেন, হিলারি আগের বিতর্কের চেয়ে তুলনামূলক সাবলীল ছিলেন। বিতর্কে হিলারি বড় ধরনের কোনো ভুল বা দৃষ্টিকটু ব্যবহার করেননি।
উপরি-উক্ত নিয়মকানুনের মধ্যদিয়ে সফলভাবে অনুষ্ঠিত হলো দুটি বিতর্ক। এখন গণমাধ্যম এবং নানা ধরনের সংগঠন বিতর্কের সফলতা-ব্যর্থতা নিরূপণে ব্যস্ত। কে জিতেছেন আর কে হেরেছেন এই নিয়ে দুই পক্ষ স্বস্বার্থে কথা বলছেন। এতদিন ধরে বিতর্কে যেসব বিষয় প্রাধান্য পেয়ে আসছে, সেগুলো হলো রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি, ইরাক যুদ্ধ, রাশিয়া তথা ভ্লাদিমির পুতিন, ইসলামিক স্টেট, ওবামার জন্মসনদ, ট্রাম্পের ট্যাক্স রিটার্ন ইত্যাদি। প্রায় দেড় বছর ধরে নির্বাচনী প্রচারণা চলছে। হিলারি ক্লিনটন তাঁর শান্ত ও রমণীয় ব্যক্তিত্ব দ্বারা গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে তুষ্ট করেছেন। তিনি শান্তিময় পৃথিবী, অভিবাসীদের প্রতি যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অবহেলিত জনশ্রেণির প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিক ও নির্দেশনা দিয়েছেন। বেকারত্ব দূরীকরণে পরিকল্পনা পেশ করেছেন। অপরদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়েছেন। মুসলমানদের আমেরিকা প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার কথা বলেছেন। সন্ত্রাস দমনের নামে গোটা বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন। মুক্ত বাণিজ্যের বিরোধিতা করেছেন। ইসলামিক স্টেটকে নিশ্চিহ্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি হিস্পানিক সম্প্রদায়ের অবৈধ অভিবাসীদের বিতাড়নের হুমকি দিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এদের সংখ্যা এক কোটিরও বেশি। হিস্পানিকদের আগমণ ঠেকাতে মেক্সিকো সীমান্তে মেক্সিকোর ব্যয়ে দেয়াল তোলার ঘোষণা দিয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি অবমাননাকর উক্তি করেছেন। ন্যাটোকে অপ্রয়োজনীয় আখ্যা দিয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্রম হ্রাসমান ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের সংকল্প ব্যক্ত করেছেন।
এসবের মধ্যদিয়েই একজন প্রার্থী বাস্তবে না হলেও দৃশ্যত বিশ্বশান্তির কথা বলেছেন। অপরদিকে আরেকজন প্রার্থী যে রূপকল্প উপহার দিয়েছেন তা পৃথিবীকে আরো গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দেবে। যদি ট্রাম্প বিজয়ী হন, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্গরাজ্য দৃশ্যত নরকে পরিণত হবে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী শক্তির হামলায় আরো বেশি করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে গোটা বিশ্বের সাধারণ মানুষ। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কিন রণকুশলী এবং ইহুদি লবি ট্রাম্পের বিজয়ের স্বার্থে নির্বাচন নিকটে আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরো সহিংসতা ও সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটাতে পারে, যাতে বিদ্বেষ বৃদ্ধি করে ট্রাম্পের বিজয় নিশ্চিত করা যায়। মার্কিন জনগণের রাজনৈতিক পরিপক্বতা সম্পর্কে কারো কোনো সন্দেহ নেই। হয়তো সমাগত নির্বাচনে সহজেই ডেমোক্রেটরা নির্বাচিত হবেন। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিদ্ধেষজনক বক্তব্যের মাধ্যমে মার্কিন জনগণের মধ্যে যে হিংসা, বিদ্বেষ ও সহিংসতা সৃষ্টি হতে পারে তা ভবিষ্যৎ জনগণের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। সাধারণত জনগণ বিবেক-বুদ্ধির চেয়ে স্বার্থবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হয়। জনগণকে সহজেই উত্তেজিত করা যায়। কিন্তু উত্তেজনা প্রশমিত করা খুবই কঠিন বিষয়। সামগ্রিকভাবে মার্কিন সমাজে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, তা সহজে পূরণ হবে না। বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান তৃতীয় বিশ্বের দেশ হওয়ার কারণে ট্রাম্পের বক্তব্যে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হয়তো আমাদের তরফ থেকে সে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা থাকবে। কিন্তু যে ক্ষত মার্কিন সমাজে সৃষ্টি হয়েছে তা সহজে পূরণের নয়।
রাজনীতিতে যেমন শেষ কথা নেই, তেমনি সমাগত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে শেষ কথা বলা কঠিন। দৃশ্যত হিলারি জনমত যাচাইয়ে অগ্রগামী আছেন, তবে যে কোনো সময় গণেশ উল্টে যেতে পারে। বিশেষ করে নির্বাচনের পূর্বক্ষণে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে জনমত ট্রাম্পের পক্ষে নিয়ে আসার ষড়যন্ত্র হতে পারে। আগেই বলা হয়েছে পরিপক্ব গণতন্ত্র, শিক্ষিত জনশ্রেণি এবং সংস্কৃতিবান মানুষ হিসেবে বিশ্ববাসী মার্কিন ভোটারদের ওপর আস্থা রাখতে চান। সুতরাং চূড়ান্ত ফলাফলের জন্য বিশ্ববাসীকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।