রাজনীতি
সবার নজর আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে

২২ ও ২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০তম কাউন্সিল। আওয়ামী লীগ শুধু বাংলাদেশে নয় এ উপমহাদেশের পুরাতন একটি রাজনৈতিক দল। এতদাঞ্চলের এটি একটি বড় রাজনৈতিক দলও। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠার পর থেকে দলটি যেমনি অর্জন করেছে অনেককিছু, ঠিক তেমনি অনেক চড়াই উৎরাইও পার করতে হয়েছে। এ দলটি গঠনের পরে দেশে কখনো সামরিক শাসন আবার কখনো সামরিক লেবাসে স্বৈরশাসন থাকার কারণে বেশির ভাগ সময়েই সরকারের বাইরে অর্থাৎ বিরোধী দলে থাকতে হয়েছে তাকে। তবে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য একটি কথা খুবই পরিষ্কারভাবে বলা যায়, আর তাহলো দলটি বিগত প্রায় সাত দশকে সরকারে থেকেও যেমন সফল ছিল, তেমনি বিরোধী দলে থেকেও একইভাবে সফলতা অর্জন করে দেখাতে সমর্থ হয়েছে।
দলটি গঠনের পর থেকে দলটির প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একে আষ্টেপৃষ্ঠে আকড়ে ছিলেন আমৃত্যু। যাঁর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মতো একটি দুর্লভ উপহার এসেছিল তাঁর আওয়ামী লীগের হাত ধরে। ঠিক তেমনি আজকের দিনে বিগত প্রায় তিন যুগ ধরে তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি এমনি একটি দলীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে ১৯৮১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিত অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের মাধ্যমে একই বছরের ১৭ মে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে দেশে ফিরেছিলেন। এ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন এবং সেই দেশকে একদিন উন্নত ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি সদ্যস্বাধীন দেশটিতে সে কাজটি শুরু করলেও ১৯৭৫ সালের ট্র্যাজেডির কারণে সেটি সম্পন্ন করে যেতে পারেননি।
সেই বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথ ধরেই স্বপ্নগুলোকে বাস্তব রূপ দেওয়ার কাজটি করে চলেছেন শেখ হাসিনা। আর তারই ধারাবাহিকতায় এবারও হয়তো নিশ্চিতভাবেই দলীয় সভাপতির পদটি নিতে হবে। তার কারণ ২০০৮ সালের জাতীয় সম্মেলনের সময় তিনি একটি অভিমান থেকে দলীয় সভাপতির পদ ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর পথ আগলে সেখানে শুয়ে পড়ে ফেরানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যেমন একজন ক্যারিসম্যাটিক নেতা ছিলেন, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা এবং দেশবাসী শেখ হাসিনার মাঝেও সেটি খুঁজে পেয়েছে। আর তাই এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগে সভাপতি হওয়ার মতো আরেকজন কিংবা তাঁর বিকল্প কোনো নেতৃত্ব এখন নেই। সেজন্য আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অপরিহার্য। অপরদিকে সাধারণ সম্পাদক পদটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনা সভাপতি থাকলে তাঁরই বিশ্বস্ত একজন সাধারণ সম্পাদক থাকাটা দলে, সরকার এবং দেশের জন্যও মঙ্গলজনক। আর তাই ২০০৮ সালে এবং ২০১২ সালের কাউন্সিলে পরপর দুইবার সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত করেছিল দল। দেখা গেছে ২০০৭ সালে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা যখন কারান্তরীণ ছিলেন তখন দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলও কারান্তরীণ হন।
সেই সময় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে প্রয়াত বর্ষীয়ান রাজনীতিক জিল্লুর রহমান সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে সঠিকভাবে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিলেও তখন সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দেশের বাইরে ছিলেন, তারপরও সেই কঠিন সময়ে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বিদেশ থেকে ফিরে দলটির দুর্দিনে জিল্লুর রহমানের সাথে যৌথভাবে কাণ্ডারী হন। তা ছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং ১৫ আগস্ট পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে থাকার অপরাধে জেলে বন্দি হয়ে জেলহত্যার মাধ্যমে আত্মত্যাগী নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের পুত্র তিনি। তিনি দলের বিশ্বস্ত কাণ্ডারী হয়ে দলকে এগিয়ে নেওয়ার পুরস্কার হিসেবে ২০০৮ সালের সম্মেলনে পূর্ণাঙ্গ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়া। তখন থেকে পরবর্তী সময়ে পরপর দুইবার আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আরোহণ এ নেতৃত্বেও অন্যতম সফলতা। তাঁর সততা, একাগ্রতা, দেশপ্রেম, বিনয়, স্পষ্ট ও মিষ্টভাষিতা; দল, রাষ্ট্র ও সমাজে অবদানের কারণে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত ১৯তম জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদক পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এবারো ২০তম জাতীয় সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে টানা তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত হওয়ার কথাই গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে জানা যাচ্ছে। তবে সবার মতামতের ভিত্তিতে পূর্ণ গণতান্ত্রিক পন্থায় অন্য বিশ্বস্ত কাউকেও সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত করলে যদি ভালো হয় তাতেও কারো কোনো অপত্তি থাকবে না। অপরদিকে এবারের কাউন্সিলে যেসব চমক থাকার কথা শোনা যাচ্ছে সেগুলো হলে দলের জন্য আরো ভালো হবে বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মনে করছেন। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে, তাঁর বোন ও বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা শেখ রেহানা, ছেলে প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে জামাই মাশরুর হোসেন প্রমুখ সম্মেলনের আগে কাউন্সিলর হয়েছেন। রেদওয়ান সিদ্দিক ববি আওয়ামী লীগের গবেষণা সেলে এবং ইউএনডিপির কনসালটেন্সি কাজ করার জন্য এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থায় কাজ করার জন্য কিছু হওয়ার শর্ত থাকায় তাঁরা কাউন্সিলর থেকে নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন বলে জানা গেছে। আর সজীব ওয়াজেদ জয় অনেক আগে থেকেই রংপুর আওয়ামী লীগ হতে প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করেছিলেন। তা ছাড়া আরেক জাতীয় নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমেদের ছেলে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ যিনি অভিমানে স্বেচ্ছায় বিদেশ নির্বাসনে রয়েছেন তিনিও এবারে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে কোন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে অভিষিক্ত হওয়ার জন্য রাজি হয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে।
সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী মহল থেকে এবং তৃণমূলের নতুন প্রজন্মের মধ্য থেকে জোর দাবি উঠেছে যাতে দলের নেতৃত্বে নতুন প্রজন্মের প্রাধান্য থাকে। সেখানে যদি সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল, রেদওয়ান সিদ্দিক ববি এবং তানজিম আহমেদ সোহেল তাজের মতো তরুণ নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণপদে নির্বাচিত হন তাহলে সবাই খুশি হবেন। তা ছ্ড়া ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর অনেক সংস্কারবাদীদেরই দল এবং সরকারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে, সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে এবারও কিছু কিছু নেতৃত্ব যাঁরা ইতিমধ্যে বিভিন্নভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন, সেই নেতাদের দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়ে এসে সবাইকে নিয়েই দেশগড়ার কাজে মনোনিবেশ করলেই মঙ্গল হবে বলে মনে করছেন অনেকে। কারণ তাহলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরিতে এ উদ্যোগটি ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারবে। আর এটিই হবে এবারের সম্মেলনের মূল আকর্ষণ, বৈচিত্র্য ও চমক।
রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের বিষয়টি বিভিন্ন জায়গায় আলোচিত হলেও তা শুধু আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের বিষয় নয়। এটি বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলেও যেমন রয়েছে, তেমনি বিশ্বের উন্নত ও অনুন্নত সব দেশেই উদাহরণ রয়েছে। এ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সম্মেলনের ২-৩ দিন আগেই রাজধানীর হোটেলে সিট খালি নেই, কারণ বিভিন্ন বিভাগ, জেলা, উপজেলা এবং তৃণমূল পর্যায় থেকে কাউন্সিলর ও ডেলিগেটসহ নেতাকর্মীরা রাজধানীতে চলে আসতে শুরু করেছে। সেখানে দলের কেন্দ্রীয কমিটির ১০০ সহসম্পাদক পদের জন্য লড়ছেন প্রায় ২০ হাজার নেতা, কেন্দ্রীয় কমিটির ৮১ পদে প্রার্থী সহস্রাধিক তা ছাড়া দলের নীতি নির্ধারণী প্রেসিডিয়ামের পদ ১৯ টিতে আসবেন অনেক পরীক্ষিত ও ত্যাগী প্রবীণ নেতৃত্ব।
আওয়ামী লীগের এ সম্মেলন উপলক্ষে আমাদের ভারত, চীনসহ চৌদ্দটি দেশের রাজনৈতিক ও সরকারি প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে দেশের জামায়াতে ইসলামী ছাড়া বিএনপিসহ ৫০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিকে। দাওয়াতের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা মতো, সেগুলো হলো- এক, যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতকে আমন্ত্রণ না জানানো, আর দুই, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আমন্ত্রণ জানানো। কারণ এতে রাজনৈতিক দূরত্ব আস্তে আস্তে কমে অসবে যা দেশে স্থায়ী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে। কাউন্সিলের বাতাস যে শুধু রাজধানী শহরেই লেগেছে তাই নয়, তা এখন দেশময় ছড়িয়ে পড়েছে। সম্মেলনের মাধ্যমে আগামী নির্বাচন এবং দেশের এবং সরকারের বর্তমান অগ্রগতি ধরে রেখে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বে স্থান করে নেওয়ার পরিকল্পনার কথা থাকবে সম্মেলনে। আমরা সবাই এর সফলতা কামনা করি।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়