জার্মানির পথে পথে
বাখারাখের এক রিটার প্রাসাদ
সাংকতগোয়া!! দাঁত ভাঙা নাম শুনে ঠোঁট উল্টে জিজ্ঞেস করলাম, ওখানে কী আছে? ‘চলো, নদী আর পাহাড় দেখে আসি। পাহাড়ের মাথায় তৎকালীন ষণ্ডা পাণ্ডাদের প্রাচীন দুর্গ আছে’। তাই!! নড়েচড়ে বসে উৎসাহিত হয়ে দ্রুত খাওয়া শেষ করায় মনোযোগ দিলাম। শনিবার রাত থেকেই আশায় থাকি পরদিন যেন আবহাওয়া ভালো থাকে। রোববার হচ্ছে ইউরোপের মাটিতে অনেকটা স্কুলের সেই ‘ছুটি, গরম গরম রুটি, এক কাপ চা, সবাই মিলে খা’। সেই রোববারে যদি আবহাওয়া মুখ ভার করে থাকে, মন টাই খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু তাই বলে ঘরে বসে থাকা অসম্ভব। আমাদের বেশির ভাগ ঝটিকা প্ল্যানই যেহেতু সকালে নাশতার টেবিলে হয়, তাই যথারীতি পছন্দের সুস্বাদু, দামেও স্বস্তা আর ৫০-৬০ ধরনের ব্রোয়েটসেন (রুটি) সংবলিত চেইন রেস্তোরাঁ গোয়েরতসে নাশতা শেষ করে আর মেঘলা আকাশকে বকাঝকা করতে করতে রওনা হলাম।
দুর্গ মানেই রহস্য আর ইতিহাস। এ ছাড়া যেকোনো নদী তীরবর্তী পাহাড়ি এলাকা দিয়ে গেলেই পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে প্রাচীন দুর্গের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতাও টের পাওয়া যায়।
নেভিগেশনের জটিলতার কারণে বিঙ্গেন শহরে এসে দেরি হয়ে যাওয়ায়, বিঙ্গেন থেকে কিছু দূর এগোতেই ডানে নদীর ধারের নিদারহাইমবাখ নামক একটা ট্রেন স্টেশনে নেমে চারপাশ টা দেখতে লাগলাম। ট্রেনলাইনের পাশের মিটারখানেক দূরত্বে পাকা করা পায়ে হাঁটার রাস্তায় সাদা দাগ টেনে দেওয়া। মি. সাবধান করলেন, দাগের পাশে যাওয়া নিষেধ, যেকোনো সময় ট্রেন আসবে। আমি মনে মনে ভাবছি, ইশ! তাতে কী? ট্রেন আসলে বুঝি জানতে পারব না। ভাবতে দেরি, কয়েক সেকেন্ডের ভেতর ট্রেন সাই করে পাশ দিয়ে এত্ত দ্রুতগতিতে গেল যে, দাগের ভেতরে না থাকলে আমিসহ উড়ে যেতাম। বেকুব হয়ে গেলাম। ‘দেখেছো, বলেছিলাম না!!’ টেরই পেলাম না!! বাপরে!! ৩০০ কিলোমিটারের অধিক গতিতে চলা শব্দহীন ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস/আন্তর্জাতিক ট্রেন হবে হয়ত। আমরা তো ট্রেন বলতেই বুঝি ‘কু ঝিক ঝিক কু’।
নদীর অপর পাশেও পাহাড়ের ঢালে ট্রেন যাওয়া আসা করছে। আবার রওনা দিয়ে বাম পাশে সারি সারি প্রাগৈতিহাসিক আমলের বাড়িঘর আর পাহাড়ের ওপর দুর্গ চোখে পড়ল, এমনভাবে তিন-চারটা দুর্গ পেরিয়ে ৬/৭ কি.মি. যাওয়ার পর আমার আর তর সইল না। আমার পীড়াপীড়িতে নদীর ধারের বাণিজ্যিক পার্কিং প্লেসে গাড়ি পার্ক করে নেমে গেলাম। জায়গাটির নাম বাখারাখ।
অসাধারণ দৃশ্য। একই সঙ্গে রোমাঞ্চকর ও রোমান্টিক। ডান পাশে নদী, নদীতে ছড়ানো-ছিটানো জাহাজ চলছে, নদীর দুই পাশেই ট্রেনলাইন দিয়ে কিছুক্ষণ পরপরই সাঁই সাঁই করে শব্দহীন ট্রেন যাচ্ছে,পাশেই রাস্তা দিয়ে গাড়ি বা মটরসাইকেল যাচ্ছে,এরপর উঁচু পাহাড়। কোথাও কোথাও পাহাড়ের ঢালে সারি সারি ঘর বাড়ি ছবির মতো সাজানো। বাম পাশে চওড়া রাস্তাটা ছাপিয়ে কার পার্কিংটার ওপরেই আরেকটা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে আর আরেকটা ট্রেন লাইন দিয়ে একটু পর পর ট্রেন যাচ্ছে,তার পরেই পৌরাণিক যুগের ৩৫০-৪০০ বছরের পুরোনো হাফ টিম্বারড বাড়িঘর যেগুলো এখন হোটেল বা রেস্তোরাঁতে রূপান্তর হয়েছে। আর ফাঁকে ফাঁকে পাহাড় কেটে পাথুরে দেয়ালের তৈরি মিনারের মতো দরজা আছে যেটা দিয়ে হেঁটে বা গাড়ি নিয়ে পাহাড়ের তল দিয়ে অপর পাশে যাওয়া যায়, এর পেছনেই আরো খাড়া পাহাড়। পাহাড়ে আঙুর বাগান, তারও অনেক ওপরে একটি দুর্গের মাথা দেখা যাচ্ছে। আমার মনে হলো, যুগ যুগ ধরে বিশাল জলরাশি আর সুউচ্চ পাহাড়ের মাঝে এখানেই এভাবে দাঁড়িয়ে থাকি সামনের ওই মৎস্যকুমারীর ভাস্কর্যের মতো।
সুইজারল্যান্ডের শাফাহাউজেন থেকে এই রাইন নদী জার্মানির অনেক জায়গাতেই এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে, অনেকটা বান্দরবানের সাঙ্গু নদীর মতো। যেদিকেই যাই, রাইন নদী তবে নাব্যতার কারণে এর ভিতর দিয়ে সব সময়ই সারা ইউরোপের জাহাজ চলছে। কয়লাবাহী একটা জাহাজ দেখে এগিয়ে গিয়ে টের পেলাম, এই শীতেও ভরা বর্ষার মতো দুকূল ছাপানো নদীতে উত্তাল স্রোতের দাপট। বুঝলাম যে,বন্যা হচ্ছে। আশে পাশের কয়েকটা জেটি ডুবে গেছে। জার্মানির এক অন্য রুপ দেখলাম। বাচ্চাদের একটা খেলার জায়গা, সেটাও বেশীর ভাগ ডুবন্ত। অন্য সব জায়গার মতো এখানেও হাঁটার জায়গা, সুবিশাল বাস, কার, সাইকেল পার্কিং। এক জায়গায় দেখলাম, নদীর পানি একটা ক্যানেল দিয়ে শহরের ভিতরে ঢুকে আন্ডার পাস ও ডুবিয়ে দিয়েছে। সচরাচর এই ধরনের ক্যানেল দিয়ে শহরের পানি নদীতে গিয়ে পড়ে।এখন উলটো ব্যাপার হচ্ছে। প্রাচীনকাল থেকেই এই পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা চালু ছিল সেটা ক্যানেলের পাথুরে দেয়াল দেখলেই বোঝা যায়। উত্তাল স্রোতের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শ্বেত রাজহাঁসেরও দেখা মিলল।
আমাকে চুম্বকের মতো টানছে ওই দুর্গটা। তাই ওইটার উদ্দেশে হাঁটা শুরু করলাম। পাহাড় কেটে ১৩২২ সালের পাথুরে দরজা ,রাস্তাঘাট দিয়ে হাটতে হাটতে একটা রূপকথার রাজ্যে চলে এলাম, ঠিক যেমনটি আগে ক্যালেন্ডার এর পাতায় দেখা যেত। জ্যামিতিক ডিজাইনের কাঠের ফ্রেমের বাড়িঘর, সবুজ বাগিচা,তার সামনে দিয়ে কুলকুল ধ্বনি তুলে লতাপাতায় মোড়ানো একটু পর পর ছোট্ট ছোট্ট পাথুরে ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে চলা প্রস্রবন। পাহাড়ে ওঠার পাথুরে সিড়ি এবং ঘোড়া, গাধা চলাচলের আলাদা মেটে রাস্তা। হাফ টিম্বারড একটা বাড়ির গায়ে দেখলাম খোদাই করা ১৫৯৩ সাল। তবু কী যত্নে ঐতিহ্য ধরে রাখার প্রয়াস, কী যে দারুণ। বর্তমানে এটি একটি পিজারিয়া বা পিজার রেস্তোরাঁ। পুরো এলাকাটিই ট্যুরিস্ট এলাকা।
আমরা বন্য জন্তু চলাচলের রাস্তাটাই বেছে নিলাম,৫২০ ফুট উচু স্টাহলেক দুর্গে ওঠার জন্য। ব্যাক্তিগতভাবে বাংলাদেশের বান্দরবানের থাঞ্চির দুর্গম খাড়া পাহাড়ে ওঠার অভিজ্ঞতার তুলনায় আমার কাছে এই পাহাড়ে ওঠা তেমন কিছুই মনে হলো না। এখানে সব কিছুই পরিকল্পিতভাবে সাজানো।
বেশ কিছুদূর ওঠার পর পাশের আরো ঊচূ আরেকটি পাহাড়ের মাঝামাঝি জায়গায় ওপরে নিচে আঙ্গুর বাগানের ফাক দিয়ে হেটে চলা পিঁপড়ের মতো মানুষদের এরিয়াল ভিউ দেখতে অদ্ভুত অপার্থিব লাগছিল ।এই অনুভূতি লিখে বুঝানো যাবে না। একটা চাতালের মতো জায়গায় এসে মুগ্ধ বিশ্ময়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। ঠিক কক্সবাজারের হিমছড়ি পাহাড়ে যেরূপ দৃশ্য দেখা যায়, অনেকটা তেমনই,তবে আরো অভিজাত। তাড়া খেয়ে আবার হাঁটা দিলাম। এরপর একটার পর একটা দুর্গের পাথুরে দরজা,পথ,সিড়ি পেরিয়ে মূল আঙ্গিনায় চলে এলাম। প্রাসাদের ভিতরের পুরো আঙিনা সবকিছুই পাথর কেটে তৈরি।
দ্বাদশ শতাব্দীর এই স্টাহলেক প্রাসাদ বর্তমানে পৃথিবীখ্যাত ইউথ হোস্টেল,যা মধুচন্দ্রিমা বা পারিবারিক বিনোদন, স্কুল ট্রিপ, হাইকিং, সাইক্লিং এর বিভিন্ন ইভেন্ট এর জন্য আদর্শ। শীতকাল হবার কারণে খুব অল্প ট্যুরিস্ট, রেলিং ঘেরা টেরেসে অনেক বেঞ্চি পাতা, গোটানো ছাতা দেখলাম যা গরমের সময় খোলা হয় বুঝলাম। পাথুরে টেবিল টেনিস কোর্ট। অন্য একটা রাস্তা ধরে আরো ওপরে উঠে একটা পাথুরে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে একদম ছাদে চলে গেলাম। ছাদে চারদিকে প্রাসাদ রক্ষণাবেক্ষণের অস্ত্র,কামান রাখার ব্যবস্থা কেমন ছিল দেখে আবার আগের আঙিনায় ফিরে এলাম কফি খাওয়ার জন্য। ওপরে ওঠার অন্য আরেকটা সিঁড়ি শুধু বোর্ডারদের জন্য সংরক্ষিত। এসব রেস্তোরাঁয় আগে থেকে বুকিং দেওয়া লাগে, এ ছাড়া কেক, কফি সব সময় ই পাওয়া যায়। ভিতরের পরিবেশ আবার অত্যাধুনিকভাবে করা, বাচ্চাদের খেলার জায়গা ও আছে।
জার্মানিতে এই ধরনের নদীর ধারের সুউচ্চ পাহাড়ে রাজা মহারাজাদের এলাকাভিত্তিক সেনাপ্রধানদের অনেক দুর্গ আছে যেখান থেকে নদীতে যাতায়াতকারী যানসমূহ নিয়ন্ত্রণ করা হোত। কথিত ভাষায় এগুলো রাজাদের 'রিটার' তথা সাগরেদ বা এলাকাভিত্তিক কাউন্টিদের। বইয়ের ভাষায় বললে 'নাইট'। এরা রাজার হয়ে শাসন, কর আদায় এমন নানাধিক কর্মসাধন করত। কোন সওদাগর বা বণিক এদেরকে ভেট না দিয়ে নৌযান নিয়ে যেতে পারতো না। এদের সীমানা ভাগ করা থাকত। ১১০০ খ্রিস্টাব্দে এই দুর্গের পত্তন ঘটেছিল। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে অনেকাংশই ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও বিংশ শতাব্দীতে কিয়দংশ মেরামত করা হয়েছে।
২০০২ সাল থেকে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ এর অন্তর্ভুক্ত ৬৫ কি.মি. বিস্তৃত রাইন নদীর একটি অংশ হলো 'রাইন গোর্জ'। ইতিহাস, কৃষ্টি, স্থাপত্যশৈলী এসব বিবেচনায় অনন্য এই অঞ্চল আর প্রাসাদসমূহ। রোমান সাম্রাজ্যের সময়ে গড়ে ওঠা মিডল আপার রাইন নদীর স্বর্গীয় সৌন্দর্যে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। আর রাত্রি যাপন করার সৌভাগ্য হলে তো কথাই নেই।
দুর্গের আঙ্গিনায় বেঞ্চি তে বসে সামনের অবারিত অপার্থিব মোহনীয় সৌন্দর্যের হিমেল শিহরণে কফির কাপে চুমুক দিতেই,আহা কি দৃশ্য। হঠাৎ মেঘের ফাক গলে এক চিলতে রোদ, নদীর বিপরীত পাড়ে আরেকটি পৌরাণিক শহর আর অন্য একটি প্রাসাদকে ছবির মতো ফুটিয়ে তুলল। সাথে সাথেই চারপাশে ক্লিক ক্লিক শাটার পড়ার শব্দ। পনিরের কেক দিয়ে উদরপূর্তি করে আর সামনের পাহাড়ের সারি, নদী, জাহাজ, মাঝে মাঝে আকস্মিক ট্রেন চলাচল সবকিছু মিলিয়ে আল্লাহ্ এর কাছে অসীম শুকরিয়া, এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখার সুযোগ দেয়ার জন্য।
সিঁড়ি ব্যবহার করে নেমে আসার সময় দেখা পেলাম রোমান যুগের তীর্থস্থান একটি বিধ্বস্ত ঐতিহাসিক গির্জা, নির্মাণকাল (১২৮৯-১৪৩০) যা উচ্চমার্গের জার্মান গোয়েথিক স্থাপ্তত্যের নিদর্শন বহন করে।শহরের ভিতরে পাথুরে রাস্তা দিয়ে অলিগলিতে হাঁটাহাঁটি করে গাড়ির কাছে ফিরে এলাম। পথে পড়ল একটা প্রাচীন কুয়া যার ওপরে একটা দড়ি বাঁধা বালতি ও ঝোলানো আছে, সব বাড়িই এখন হোটেল বা রেস্তোরাঁ।
সাংকতগোয়া আর যাওয়া হলো না। সেখানের ইতিহাস আর নিসর্গ আরো সমৃদ্ধ। তাতে কী? তোলা রইল অন্য আরেক দিনের জন্য।