যুক্তরাজ্যেও জুয়ায় আসক্ত অনেক বাংলাদেশি
বাংলাদেশে এখন সব থেকে বেশি আলোচিত বিষয় ক্যাসিনো। জুয়া খেলার এই অভিনব বিষয়টি বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষের কাছেই অচেনা, বিশেষ করে বাঙালি নারীদের কাছে। দেশের মধ্যে এত ক্যাসিনো আছে, তা হয়তো জানা ছিল না অনেক উচ্চবিত্ত পুরুষেরও। যারা কি না মালয়শিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ব্রিটেন বা আমেরিকার মতো দেশগুলোতে ভ্রমণ করে থাকে শুধুমাত্র ক্যাসিনো খেলার জন্য। দেশের অল্পকিছু মানুষের কাছে যেখানে ক্যাসিনো একটি আতঙ্কের নাম, সেখানে ব্রিটেনে বসবাসরত বাংলাদেশি বেশির ভাগ পরিবারের কাছে আতঙ্কের নাম এই ক্যাসিনো।
ইস্ট লন্ডন অ্যাডভাইজারের তথ্যমতে, চলতি বছরের ১১ জুলাই জুয়া খেলার জন্য স্ত্রীর কাছ থেকে টাকা চেয়ে না পেয়ে বাংলাদেশি জুয়াড়ি জালাল উদ্দিন (৪৭) তার স্ত্রী আসমা বেগমকে (৩১) ৫৮ বার ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি ও রয়টার্সে সংবাদটি বড় করে প্রকাশ করা হয়। সংবাদটি দেখার পর নিজে খুব আশ্চর্য হলাম যে, এমন উন্নত দেশে এসেও জুয়া খেলার জন্য স্বামী তার স্ত্রীকে হত্যা করছে। সাংবাদিকতা করার কারণে এই ঘটনা পড়ার পর অনেক বাঙালি নারীর সঙ্গেই কথা হয় আমার। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে যা জানতে পারি, তা আমার কাছে আরো ভয়ানক লাগল। আমার সঙ্গে পরিচিত অনেক নারীর স্বামীই ক্যাসিনো বা জুয়ার সঙ্গে যুক্ত।
পরিবার পরিজন ছেড়ে দূর প্রবাসে এসব নারী হয়তো তাঁদের পরিবারের কাছে জানাতে পারে না স্বামীদের এই আসক্তির কথা। নারীরা যখন স্বামীর এই অর্থ নষ্ট করা রুখতে পারে না, তখন পরিবারের হাল ধরতে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে অনেক প্রবাসী বাঙালি নারী। ব্রিটেনের অনেক নারী যখন দিন শেষে কাজ করে বাড়ি ফেরে, তখন তাদের স্বামীরা হয়তো ব্যস্ত জুয়া খেলা নিয়ে।
নারীদের মুখে এমন কথা শুনে অনেকটা আগ্রহ নিয়েই ব্রিটেনের বেশ কিছু ক্যাসিনো খেলা দেখতে যাই আমি। সপ্তাহের শেষ দিন রোববার কিংবা শুরুর দিন সোমবার মানেই ক্যাসিনো বা জুয়ার আসরগুলোর চারপাশে চোখ বুলালেই দেখা মিলবে অনেক বাঙালির। ক্যাসিনোতে কাজ করে এমন কয়েকজন জানায়, বাঙালিরা অল্প টাকা নিয়ে জুয়া খেলতে আসে। বেশিরভাগই সব টাকা হারিয়ে যায়। আর এখানকার জুয়ায় আসক্তদের বড় একটি অংশ হচ্ছে ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী। এ ছাড়া অনেক বয়স্ক লোকও নিয়মিত এসব জুয়ার ঘরে গিয়ে থাকে।
অন্যদিকে ইস্ট লন্ডনের জুয়ার ঘরে বেশির ভাগ সাউথ এশিয়ান আসে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আবার বাংলাদেশি। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে এদের মধ্যে অনেক বাঙালি নারীও আসে জুয়া খেলতে। বাজির দোকানগুলোতে ফুটবল, ক্রিকেট, ইলেকশন ইত্যাদি শত শত বিষয়ে বাজি ধরার সুযোগ থাকলেও বাঙালি বয়স্করা ঘোড়ার দৌড়েই বাজি ধরে বেশি। তরুণরা ফুটবলে বাজি ধরার ব্যাপারে আগ্রহী বেশি।
উইকিপিডিয়ার দেওয়া তথ্যমতে, লাইসেন্সকৃত মোট নয় হাজার জুয়ার ঘর রয়েছে পুরো ব্রিটেনে। বছরে ১৪ বিলিয়ন পাউন্ডের জুয়া খেলা হয় ব্রিটেনজুড়ে। বাংলাদেশি টাকায় সেটা প্রায় এক লাখ ৫৪ হাজার ৪৫ কোটি টাকা।
ব্রিটেনে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি বসবাস করে টাওয়ার হ্যামলেট এলাকায়। গত বছর টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, তিন লাখ বাসিন্দার এই কাউন্সিলে রয়েছে মোট ৯০টি জুয়ার দোকান। এই কাউন্সিলে বাংলাদেশি রয়েছে লক্ষাধিক যা মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। কাউন্সিলের জুয়া বিষয়ক রিপোর্টে বলা হয়েছে, শুধু টাওয়ার হ্যামলেটেই রয়েছে ছয় হাজার নিয়মিত জুয়াড়ি। এর মধ্যে অন্তত তিন হাজারের বেশি বাংলাদেশি জুয়ায় আসক্ত।
এখানকার আইনজীবীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, সারা বছরে যেসব ডমেষ্টিক ভায়োল্যান্সের কেইস আমরা পাই তার একটি অংশ জুয়া খেলার অশান্তি থেকে সৃষ্ট। অল্পতে টাকার মালিক হওয়ার প্রবণতা থেকে জুয়ার দিকে আসক্তি বাড়ে অনেকের। যার শেষ পরিণতি হয় ভয়াবহ।
জুয়ার বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে আরো ভয়াবহ তথ্য! লাইসেন্সড জুয়ার ঘরের বাইরেও বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেকেই নিজের ঘরেই জুয়ার আসর বসিয়ে থাকে। টাওয়ার হ্যামলেটস, নিউহ্যাম বিভিন্ন এলাকায় এসব ঘরোয়া আসরের অংশগ্রহনকারী অনেক নামিদামি ব্যবসায়ী, রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কমিউনিটির কিছু নামকরা মানুষ। মূলত যারা রাস্তার পাশে বা মোড়ের বাজির দোকানে যেতে পারে না চক্ষুলজ্জার কারণে তারাই এসব আসরের মূল টার্গেট। এসব আসর ঘিরে ইস্ট লন্ডনের বিভিন্ন গ্যাং নানা ধরনের বাণিজ্য করে থাকে। মুলত জুয়ার আসরে টাকা শেষ হয়ে গেলে তাৎক্ষণিক টাকার জোগান দেওয়ার জন্য কিছু গ্যাং রেডি থাকে। সময়মতো সেই টাকা সুদসমেত ফেরত না দিলে নানা ধরনের বিপদ নেমে আসে। তবে এসব ঘরোয়া আসরে মূলত বিভিন্ন ধরনের তাস খেলার ওপর বাজি ধরা হয়।
বৈধ হোক আর অবৈধ জুয়ার আসর হোক, ব্রিটেনের অর্থনীতিতে বছরে ১৪ বিলিয়ন পাউন্ড জোগান দেওয়া জুয়ার একটি বড় অঙ্কের টাকা যে বাংলাদেশিদের পকেট থেকে যাচ্ছে সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আর এই কারণে পুড়ছে অনেক বাংলাদেশির সংসার। নিজ পরিবার থেকে দূরে এসে স্বামী সংসার নিয়ে নিশ্চিতে যেখানে সংসার করার কথা নারীর, সেখানে অনেক নারীই জুয়ার কারণে আতঙ্কে দিন কাটায়।