রোজাদারের জন্য বর্জনীয় : মিথ্যা কথা ও বর্বরতা

আরবিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘আস্ সিদকু ইয়ুনজি ওয়াল কিজবু ইয়ুহলিক’, অর্থাৎ সত্য মুক্তি দেয় আর মিথ্যা ধ্বংস করে। সত্য কথা বলার কারণে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছে এবং মিথ্যা বলার কারণে জীবন দিতে হয়েছে—এ রকম হাজার হাজার ঘটনা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে। মিথ্যা কথা যে শুধু মানুষকে পার্থিব জীবনেই সমূহ বিপদের সম্মুখীন করে তা-ই নয়, বরং মিথ্যা মুমিনের পরকালীন প্রাপ্তিকেও ধ্বংস করে দেয়। বিশেষ করে রোজাদারের রোজা মিথ্যা কথা বলা এবং অনর্থক কাজের দরুন দুর্বল হয়ে যায় এবং সে তার আমলের সওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা এবং তার ওপর ভিত্তি করে কাজ করা আর জাহেলদের মতো আচরণ বর্জন করল না, তার খাদ্য ও পানীয় বর্জনে (রোজা রাখাতে) আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। (সহিহ আল-বোখারি : ১৯০৩, সুনানে ইবনে মাজা : ১৬৮৯, সুনানে আবু দাউদ : ২৩৬২, সুনানে তিরমিজি : ৭০৭, মুসনাদে আহমাদ : ৯৮৩৯, মুসনাদে বাজ্জার : ৮৪২৮, আস্ সুনানুল কাবীর : ৩২৩৩, সহীহ ইবনে খুজাইমা : ১৯৯৫)
হজরত আবদুল কাদের জিলানীর (রহ.) বাল্যকালের ঘটনা। তিনি যখন বিদ্যার্জনের উদ্দেশ্যে এক বাণিজ্যিক কাফেলার সঙ্গে বাগদাদ যাচ্ছিলেন, তাঁর মা তাঁর জামার আস্তিনের ভেতর সেলাই করে সামান্য কিছু স্বর্ণমুদ্রা ছেলের খরচের জন্য দিয়ে দিয়েছিলেন। পথিমধ্যে কাফেলা দস্যুদের কবলে পড়লে দস্যুরা কাফেলার সবার অর্থ-কড়ি কেড়ে নেওয়ার পরে বালক আবদুল কাদেরকে দস্যু সর্দার জিজ্ঞাসা করল, তোমার কাছে কী আছে? ওলিকুল শিরোমণি বালক আবদুল কাদের তাঁর প্রবাস জীবনের একমাত্র সম্বল স্বর্ণমুদ্রাগুলো মায়ের সেলাই করে দেওয়া গোপন জায়গা থেকে বের করে দিলেন। ডাকাত সর্দার আশ্চর্যান্বিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি স্বর্ণমুদ্রাগুলোর কথা না বললে আমরা তো জানতে পারতাম না। তুমি বলে দিলে কেন? হজরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) মায়ের আজ্ঞা স্মরণ করিয়ে দিয়ে দস্যু সর্দারকে বললেন, মিথ্যা বলা যে মহাপাপ। এতটুকুন একটি বালকের মিথ্যার মহাপাপ থেকে বাঁচতে নিজের শেষ সম্বলটুকু ডাকাতের হাতে তুলে দেওয়ার মতো বিরল ঘটনায় অভিভূত হয়ে ডাকাতদের দলনেতা তৎক্ষণাৎ তার দলবল নিয়ে তওবা করে প্রতিজ্ঞা করল, আর অন্যায়-পাপাচার নয়, এখন থেকে সত্যই হবে জীবনের একমাত্র চলার পথ।
রোজার অনুশীলন মুমিনের জীবনকে পূর্ণাঙ্গভাবে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠা করার জন্য, বর্বরতা থেকে সভ্যতার শিখরে উত্তরণের জন্য। তাই রোজাদার যেমন মিথ্যাশ্রয়ী হতে পারে না, তেমনি রোজাদার অশ্লীলভাষী, বর্বরের মতো আচরণও করতে পারে না। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : রোজা জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য ঢালস্বরূপ। সুতরাং তোমাদের কেউ যখন রোজা রাখবে, সে পাপাচার করবে না, ক্রোধান্বিত আচরণ করবে না। যদি কেউ তাকে গালি দেয় বা তার সঙ্গে গণ্ডগোল করতে আসে, তাহলে সে বলে দেবে, আমি একজন রোজাদার মানুষ। (সহিহ আল-বোখারি; ১৯০৪, সহিহ মুসলিম : ১১৫১, সুনানে নাসাঈ : ২২১৭, আস্ সুনানুল কুবরা : ২৫৩৭, মুসনাদে আহমাদ : ৭৬৯৩) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, অপর এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : যদি কেউ তার সঙ্গে মারামারি করতে আসে অথবা তাকে থাপড় মারে, তাহলেও সে তার প্রতি উত্তর করবে না। সে শুধু বলে দেবে, আমি একজন রোজাদার। (আল মুজামুল আওসাত : ৯০৪২)
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনে সব মানবিক গুণের একত্র ও পূর্ণাঙ্গ সমাবেশ ঘটেছিল। বিশেষ করে সর্বকালীন ইতিহাসের বর্বরতম যুগে আল্লাহর রাসূল তাঁর সততা দিয়েই আলোকিত করে তুলেছিলেন মনুষ্য সমাজকে। আর সে কারণেই রাসূলের সব গুণের ঊর্ধ্বে তাঁর সততা স্থান করে নিয়েছিল এবং বর্বর আরবরা তাঁকে আল-আমীন বা সত্যবাদি উপাধিতে ভূষিত করেছিল। মহান আল্লাহ মুমিনদের সব সময় সত্যাবলম্বী থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন এরশাদ হয়েছে, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো। (সূরা আত-তাওবাহ : ১১৯) আর কিয়ামতের দিন সত্যবাদীদের সত্যবাদিতাই তাদের মুক্তিকে ত্বরান্বিত করবে। এরশাদ হয়েছে, আল্লাহ বলবেন : আজ সত্যবাদীদের সত্যবাদীতাই তাদের উপকারে আসবে। তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণা প্রবাহিত; তারা চিরকাল সেখানে থাকবে। আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট। আর এটাই মহা সাফল্য। (সূরা আল-মায়িদাহ : ১১৯) মিথ্যার সয়লাবে ভাসমান পৃথিবীকে মুক্ত করতে সত্যের বাণী কোরআন এই রমজানে নাজিল হয়েছিল। মুমিনের হৃদয়কে মিথ্যার কলঙ্ক থেকে মুক্ত করতে রমজানে সিয়াম সাধনাকে ফরজ করা হয়েছে। সুতরাং রোজাদারকে তার রোজা এবং ইমানের সুরক্ষায় মিথ্যাকে চিরতরে বর্জন করে সত্যকে আঁকড়ে ধরে জীবনযাপন করতে হবে।