আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জনে জাকাত

ইসলামের সব শিক্ষার মূলেই রয়েছে আত্মশুদ্ধি। এমনকি ইবাদত-বন্দেগিও কিয়ামতের দিন আত্মশুদ্ধির মানদণ্ডে পরিমাপ করা হবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সৌন্দর্য ও সম্পদের দিকে তাকাবেন না, বরং তিনি দেখবেন তোমাদের আমল ও অন্তর (সহিহ মুসলিম : ২৫৬৪, বায়হাকি শুআবুল ইমান : ৯৯৯৪, মুসনাদে ইসহাক ইবনে রাহওয়ায় : ৩৭৯, মুসনাদে আহমাদ : ৭৮৩৭) আলোচ্য হাদিসের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ বলেছেন, কিয়ামতের দিন মুমিনের আমল পরিমাপ করা হবে তার আত্মার বিশুদ্ধতার ভিত্তিতে। অর্থাৎ শুধু আমল করলেই হবে না, বরং যে আমল একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর উদ্দেশে নিবেদিত হবে, সেটাই মিজানের পাল্লায় বেশি ভারী হবে। পক্ষান্তরে, আমল দৃষ্টিনন্দন হলেও যদি সেটা পরিশুদ্ধ আত্মার নিবেদন না হয়, তাহলে তার বিন্দুমাত্র মূল্য আল্লাহর দরবারে নেই। এরশাদ হয়েছে, ‘কিয়ামতের দিন কারো সম্পদ ও সন্তান কোনোই কাজে আসবে না; কিন্তু আল্লাহ যাকে একটি পরিশুদ্ধ আত্মা দান করেছেন। (সূরা আশ্-শুআরা : ৮৮, ৮৯)
আন্তরিকভাবে মহান আল্লাহর প্রতি নিজের সর্বস্ব নিবেদন করার নামই হলো ইসলাম। তাই পৃথিবীতে যত নবী-রাসূলের আগমন হয়েছিল, সবার উদ্দেশ্য ছিল একটাই আর তা হলো, মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে তোলা। মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন তাদের মধ্য হতে একজনকে তাদের নিকট রাসূল হিসেবে প্রেরণ করে। তিনি তাদের পাঠ করে শোনান তাঁর আয়াতসমূহ এবং তাদের আত্মিকভাবে পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদের কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দান করেন। নিশ্চয়ই তারা ইতোপূর্বে স্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে ছিল (সূরা আলে ইমরান : ১৬৪) আম্বিয়ায়ে কেরাম আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য যেসব কর্মসূচি দিয়েছেন, তার অন্যতম হলো সাদাকাত। আর সাদাকায়ে ওয়াজিবাহর নাম হলো জাকাত। ইসলামের পাঁচটি মৌলিক বিধানের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এই জাকাতের সঙ্গে আত্মিক পরিশুদ্ধির একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মহান আল্লাহ স্বীয় রাসূল (সা.)-কে জাকাত আদায়ের নির্দেশ দিয়ে এরশাদ করেছেন, ‘আপনি তাদের সম্পদ থেকে সাদাকাহ (জাকাত) আদায় করুন! যা দ্বারা আপনি তাদের পবিত্র করবেন (গুনাহের কালিমা থেকে) এবং তাদের আত্মিকভাবে পরিশুদ্ধ করবেন। আর আপনি তাদের জন্য দোয়া করুন! নিশ্চয়ই আপনার দোয়া তাদের জন্য বিশেষ প্রশান্তি। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (সূরা আত্-তাওবা : ১০৩)
সম্পদের সঙ্গে অহংকার অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদের মালিক হলে নিজেকে অন্যের তুলনায় বেশি মর্যাদাবান, প্রতিপত্তিশালী, প্রভাবশালী ও উঁচু স্তরের বলে মনে হয়। আর এটাই অহংকার। অহংকার মুমিনের ইমানকে যেমন দুর্বল করে দেয়, তেমনি আমলকেও ধ্বংস করে ফেলে। তাই জাকাত আদায়ের মাধ্যমে নিজের কষ্টার্জিত সম্পদ থেকে দরিদ্র মানুষের অধিকারটা হিসাব করে যদি তাদের বুঝিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে দাতার আত্মা অহংকার থেকে মুক্ত থাকবে এবং পরিশুদ্ধ হবে। যদি জাকাত আদায়ে নিজের দায়মুক্তি ও অন্যের অধিকার বুঝে দেওয়ার উপলব্ধি থাকে, তাহলেই কেবল আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে গরিবের প্রতি অনুকম্পার মানসিকতা আত্মার কলুষতাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। মুমিনের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন, ‘তারা শুধু আল্লাহর ভালোবাসায় স্বপ্রণোদিত হয়ে এতিম, মিসকিন, বন্দিদের খাবার খাওয়ায়। (খাবার দেওয়ার সময়) তারা বলে, আমরা শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তোমাদের খাবার দিচ্ছি, এর বিনিময়ে আমরা তোমাদের কাছ থেকে কোনো প্রকার প্রতিদান চাই না, এমনকি কৃতজ্ঞতাও কামনা করি না। (সূরা আদ্-দাহ্র : ৮, ৯) জাকাত ধনীর সম্পদে দরিদ্রের অধিকার। এ অধিকার মহান আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘আর তাদের সম্পদে সাহায্যপ্রার্থী ও বঞ্চিতদের নির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে। (সূরা আল-মাআরিজ : ৩৮) নিজের কষ্টার্জিত সম্পদে অন্যের অধিকার আছে, এটি মেনে নেওয়া এবং দায়মুক্তির জন্য পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করে জাকাত আদায় করা মুমিনের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং ইমানকে পরিপূর্ণ করে।