ঈদুল ফিতর
সর্বজনীন ধর্মীয় উৎসব

ইসলাম ফিতরাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি ধর্ম। অর্থাৎ মনুষ্য স্বভাব ও প্রকৃতি যা কিছু কামনা করে, তার মানবিকীকরণ এবং মানবজীবন ও সমাজকে সুন্দরায়ণের বিধিব্যবস্থার নাম ইসলাম। জীবনে যা ধারণ করা স্বাভাবিক নয়, তা ইসলাম পরিচয়েরও যোগ্য নয়। তাই বিরস বৈরাগ্য সাধন, ধর্মের নামে আত্মদহন ইসলাম অনুমোদন করে না। জীবনকে আনন্দ-বিনোদনে প্রফুল্ল করে তোলা, অতঃপর পরিতৃপ্ত হৃদয়ে স্রষ্টার প্রতি নিবেদিত হওয়াই তো আসল ধর্মসাধনা। তাই তো ইসলাম মুসলমানদের জন্য বছরে দুটি জাতীয় উৎসবের আয়োজন করেছে। একটি শাওয়াল মাসের প্রথম দিনে পালিত হয় ঈদুল ফিতর নামে আর দ্বিতীয় ঈদুল আজহা, যা পালিত হয় জিলহজ মাসের ১০ তারিখে।
ইসলামী ঈদের সূচনা
মহানবীর (সা.) মক্কী জীবনে জীবনটা নিয়ে বেঁচে থাকাটাই ছিল অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। তাই সেখানে সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান পালন ও উদযাপনের সুযোগ মোটেও ছিল না। মহানবী (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করলেন, তখন মুসলমানদের সামাজিক স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার সুযোগটি প্রথম এসেছিল। হিজরি দ্বিতীয় বর্ষে মহান আল্লাহ স্বীয় রাসূলের (সা.) মাধ্যমে মুসলমানদের জাতীয় উৎসব পালনের আজ্ঞা প্রদান করেন। হজরত আনাস (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) হিজরত করে মদিনায় এলেন, তখন সেখানকার অধিবাসীরা বছরে দুটি আনন্দ উৎসব আয়োজন করত। তাতে তারা খেলাধুলা ও আনন্দ-ফুর্তি করত। রাসূলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, এ দুটি দিনের বিশেষত্ব কী? তাঁরা উত্তর দিলেন, আমরা জাহেলি যুগে এই দুই দিনে খেলাধুলা ও আনন্দ-ফুর্তি করতাম। (আর সে ধারা এখনো অব্যাহত আছে) তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আল্লাহতায়ালা তোমাদের আনন্দ উদযাপনের জন্য এ দুই দিনের পরিবর্তে উত্তম অন্য দুটি দিন নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তার একটি হলো ফিতরের দিন আর অন্যটি কোরবানির দিন। (সুনানে আবু দাউদ : ১১৩৪, আল-মুসদাতরেক আলাস্ সহিহাইন : ১০৯১, মুসনাদে আহমাদ : ১৩৬২২) সেই থেকে মুসলিম সমাজে দুটি জাতীয় উৎসব পালিত হয়ে আসছে।
সর্বজনীন ধর্মীয় উৎসব
ইসলাম মানবতার ধর্ম। বিশ্বভ্রাতৃত্ব ইসলামের আদর্শিক শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম পরিচয়। সর্বজনীনতা এর অন্যতম উপাদান। তাই সমাজের কেউ ভোগের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকবে আর কেউ জীবন-যন্ত্রণায় কাতর আর্তনাদ করবে চিরকাল, কেউ আনন্দ-উৎসবে মেতে থাকবে আর কারো জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রম অন্যের ভোগের গ্রাসে পরিণত হবে—মানব সমাজের এমন দৃশ্য ইসলাম দেখতে চায় না। তাই ইসলাম মুসলমানদের জন্য জাহালতের ধারায় বয়ে আসা কুরুচিপূর্ণ ও বৈষম্যমূলক উৎসবে যোগদান নিষিদ্ধ করে সর্বজনীন উৎসব হিসেবে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা প্রচলন করেছে। ঈদের সর্বজনীনতা রক্ষায় ইসলাম কার্যকর বিধানও প্রণয়ন করেছে।
ঈদুল ফিতরের সর্বজনীনতা রক্ষায় ইসলামের বিধান
(ক) রোজা হারাম : ঈদুল ফিতরের সর্বজনীনতা রক্ষার জন্য ইসলাম মুসলমানদের ওপর এ দিনে রোজা রাখা হারাম ঘোষণা করেছে, যাতে কেউ নফল রোজা পালনের মাধ্যমে জাতীয় উৎসবের সর্বজনীনতাকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করাতে না পারে। কারণ, যে উৎসবে জাতির সব সদস্য সমানভাবে অংশগ্রহণ করে না, তাকে জাতীয় উৎসব বলা যায় না। হজরত আবু উদাইদ (রা.) বর্ণনা করেছেন : তিনি বলেন, একবার এক ঈদুল আজহার দিনে আমি হজরত উমরের (রা.) কাছে উপস্থিত ছিলাম। তিনি নামাজ দিয়ে ঈদের দিনের আমল শুরু করলেন। অতঃপর খুতবা দিলেন। তিনি তাঁর খুতবায় বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে এ দুই দিনের রোজা নিষিদ্ধ করতে শুনেছি। ফিতরের দিন, সেটা তো তোমাদের রোজা ভঙ্গ করার দিন এবং মুসলমানদের আনন্দের দিন। আর ঈদুল আজহার দিনে তোমরা তোমাদের কোরবানির মাংস খাবে। (সুনানে আবু দাউদ : ২৪১৬, সহিহ ইবনে খুজাইমা : ২৯৫৯, আস্-সুনানুল কুবরা : ৮২৪৯,)
(খ) সাদাকাতুল ফিতর : ঈদুল ফিতরকে সর্বজনীন করে তুলতে ইসলাম সামর্থ্যবানদের ওপর সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব করে দিয়েছে। কারণ, ঈদের উপকরণ নতুন কাপড়, ভালো খাবার, সুগন্ধি ইত্যাদি জোগাড় করতে চাই টাকা। সমাজের দরিদ্র মানুষ, যাদের দৈনন্দিন জীবনটা চলে বঞ্চনা আর বেদনায় জরাজীর্ণ অবস্থার মধ্য দিয়ে, তাদের পক্ষে আনন্দের উপকরণ জোগাড় করা সম্ভব নয়। তাই ইসলাম সামর্থ্যবানদের ওপর তাদের রোজা শোধক (ভুল-ত্রুটির পরিমার্জনা) হিসেবে সাদাকাতুল ফিতরকে ওয়াজিব করেছে। আর এটাকে দরিদ্র মানুষের অধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে, যাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী অন্যের দয়া বা অনুগ্রহের অসহায় ভোক্তা হিসেবে হীনমন্যতায় ঈদ আনন্দে আত্মার অভিব্যক্তি হারিয়ে না ফেলে। (সুনানে আবু দাউদ : ১৬০৯, সুনানে দারেমি : ২০৬৭, মুসদাতরেকে হাকেম : ১৪৮৮, আস্-সুনানুল কুবরা : ৭৬৯২, ফাজাইলুল আওকাত : ১৪৭, মারেফাতুস সুনান : ৮৪৩৮)
(গ) সালাতুল ঈদ : ঈদ আনন্দের সর্বজনীনতার আরেকটি বড় উপাদান হলো সালাতুল ঈদ। ঈদের দিন প্রথম প্রহরে এলাকার সব মানুষ উন্মুক্ত ময়দানে সমবেত হয়ে একই ইমামের পেছনে ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ছোট-বড়, সাদা-কালো নির্বিশেষে একই কাতারে দাঁড়িয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে মানবিক ঐক্য আর সাম্য-মৈত্রীর যে মহিমা ফুটে ওঠে, সত্যিই তা বড় আনন্দের!
জাতীয় উৎসবের দিন সবকিছুর আগে সম্মিলিতভাবে খোলা মাঠে আল্লাহর উদ্দেশে নামাজ আদায়ের পবিত্র দৃশ্য মহান আল্লাহ খুবই ভালোবাসেন। তাই তো তিনি ঈদগাহে সমবেত মুসল্লিদের দেখিয়ে ফেরেশতাদের বলতে থাকেন, দেখ আমার ফেরেশতারা! আমার বান্দাগণ তাদের ওপর আমার বিধান (রমজান মাসের রোজা) পালন শেষে আমার বড়ত্ব বর্ণনা করতে করতে প্রার্থনার জন্য সমবেত হয়েছে। আমার বড়ত্ব আর মহত্বের শপথ! আমি তাদের সব প্রার্থনা মঞ্জুর করব। অতঃপর মহান আল্লাহ সমবেত সকল মুসল্লিকে উদ্দেশ করে বলেন, তোমরা ফিরে যাও! আমি তোমাদের সব গুনাহ মাফ করে দিয়েছি এবং তোমাদের পাপগুলো পুণ্য দিয়ে বদলিয়ে দিয়েছি। (বায়হাকি-শুআবুল ইমান : ৩৪৪৪, ফাজাইলুল আওকাত : ১৫৫, আহাদিসুল কুদসিয়্যাহ : ১৬৮)
বছর ঘুরে আসা ঈদুল ফিতরের আজকের দিনটি হোক সর্বজনীন উৎসবের দিন, বৈষয়িক আনন্দ পূর্ণ হোক খোদানুত্যের নির্মল ধারায়। ঈদ মোবারক।
লেখক : পেশ ইমাম ও খতিব, রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রীয় মসজিদ।