হজ ও ওমরাহ
হজযাত্রীদের যা জানা ও করা প্রয়োজন

সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য জীবনে একবার হজ পালন অবশ্যকর্তব্য। আমরা সব সময় চর্চা করি না বলে হজ পালন সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা থাকে না। হজের শুদ্ধ পদ্ধতি, হজের প্রস্তুতি এসব বিষয়ে জানা আমাদের কর্তব্য। এ লক্ষ্যেই এনটিভির বিশেষ অনুষ্ঠান ‘হজ ও ওমরাহ’। এ অনুষ্ঠানে হজ, ওমরাহসহ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে দর্শক প্রশ্ন করেন। জয়নুল আবেদীন আজাদের উপস্থাপনায় এ অনুষ্ঠানে দর্শকের মনে জাগা এসব প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেন বিশিষ্ট আলেম ড. মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ।
‘হজ ও ওমরাহ’র প্রথম পর্বের অনুলিখন করেছেন জহুরা সুলতানা।
আজ প্রকাশিত হলো প্রথম পর্বের প্রথম কিস্তি
কিছুদিন আগে আমরা পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন করেছি। এরপরই আমাদের সামনে যে একটি মহান বিষয়, একটি অনন্য ইবাদতের বিষয় উপস্থিত হচ্ছে, সেটি হলো হজ। বাংলাদেশের মানুষের মনে একটাই আকাঙ্ক্ষা, ‘দূর আরবের স্বপ্ন দেখি, বাংলাদেশের কুটির হতে।’ ধনী-গরিব, নর-নারী নির্বিশেষে প্রতিটি মুসলমানের মনে একটি আকাঙ্ক্ষা, কখন পবিত্র ভূমি মক্কায় যাবেন, কখন হজ করবেন। এই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে হলে প্রস্তুতির জন্য হজের বিধিবিধান সম্পর্কে জানা প্রয়োজন, করণীয় সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে সহযোগিতা করার জন্যই আমাদের এই আয়োজন ‘হজ ও ওমরাহ’।
প্রস্তুতি
হজের প্রস্তুতির জন্য আপনাদের পাসপোর্ট থাকতে হবে, হজের যাওয়ার আগে নির্দিষ্ট সময়ে ভ্যাকসিন নিতে হবে, ভিসা পেতে হবে, টিকেট করতে হবে এবং একটা আইডি কার্ড সংগ্রহ করে নিতে হবে।
এহরামের প্রস্তুতি
এহরামের প্রস্তুতির জন্য আপনাদের যে কাজটি করতে হবে সেগুলো যেদিন আপনার ফ্লাইট, সেদিন আপনি এই কাজগুলো করবেন না। ফ্লাইট হওয়ার একদিন বা দুদিন আগে আপনি কাজগুলো করবেন। এর মধ্যে রয়েছে—
যাত্রা আরম্ভের পূর্বেই করণীয় (নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য)
১. পুরুষ ও মহিলা উভয়ের জন্য শারীরিক পরিচ্ছন্নতা অবলম্বন করা, যেমন—নখ কাটা ও শরীরের অবাঞ্ছিত লোম পরিষ্কার করা।
যেদিন ওমরাহর ফ্লাইট হবে, সেদিন করণীয়
২. অজু বা গোসল করে পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা এবং দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করা।
(পুরুষ)
৩. পুরুষরা সেলাইযুক্ত যত কাপড় আছে, অন্তর্বাসসহ, সেগুলো খুলে সেলাইবিহীন দুটো কাপড় পরিধান করবেন। একটি কাপড় থাকবে নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত সতর ঢাকার জন্য এবং আরেকটি কাপড় পিঠের দুই কাঁধসহ পিঠ ঢাকা থাকবে।
(মহিলা)
৪. মেয়েরা সাধারণত পরিষ্কার, পবিত্র যে ধরনের পোশাক আছে তা তাঁরা পরিধান করবেন। তবে মেয়েদের জন্য অবশ্যই হাতের কব্জি ও মুখমণ্ডল—এ দুটি জায়গা খোলা থাকতে হবে।
এহরাম বাঁধার স্থান
মিকার থেকে এহরাম বাঁধা উত্তম। তবে বর্তমান সময়ে বাসা, হজক্যাম্প, বিমানবন্দর যাওয়ার পরে বোর্ডিং, ইমিগ্রেশন, চেকিং শেষ করার পর অথবা প্লেনে উঠেও এহরাম বাঁধতে পারেন।
এহরামের নিয়ত
এহরামের নিয়ত বা সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে এহরামের উদ্দেশ্যের ওপরে। আমরা যেহেতু তামাত্তু হজকারী, আমাদের উদ্দেশ্য তামাত্তু হজ করা, সুতরাং যখন বের হবেন আপনার কাজ হবে ওমরাহ করা। তাই নিয়ত হবে ওমরাহর জন্য।
লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা উমরাতান (হে আল্লাহ আমি হাজির, উমরাহ করার জন্যে)
তালবিয়া পড়া
নিয়ত করার পর তালবিয়া পড়তে হবে।
লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাই্কা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নিয়া'মাতা লাকাওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক। (অর্থ—আমি হাজির, হে আল্লাহ। আমি হাজির, আমি হাজির, আপনার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা ও নেয়ামত আপনারই, সমগ্র রাজত্বও আপনারই, আপনার কোনো শরিক নেই।)
তালবিয়া যখন পড়বেন, তখন তিনবার করে তালবিয়া পড়বেন। ছেলেরা উচ্চ স্বরে ও মেয়েরা ক্ষীণ স্বরে তালবিয়া পড়বেন। যখন এহরামের ভেতর যখন প্রবেশ করবেন, নিয়ত করবেন যখন থেকে তালবিয়া পড়া শুরু করবেন এবং এর পরে ওমরাহ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এবং কাবাতে ঢুকে, বায়তুল্লাহে ঢুকে, কাবাঘর দেখা না পর্যন্ত আপনার কাজ হবে শুধু তালবিয়া পড়া। যখন যে অবস্থায় থাকবেন, সে অবস্থায়ই তালবিয়া পড়তে থাকবেন। ওপরে ওঠার সময় তালবিয়া পড়বেন, নিচে নামার সময় তালবিয়া পড়বেন, বসে থাকলেও তালবিয়া পড়বেন, ঘুমাতে গেলেও তালবিয়া পড়বেন, ঘুম থেকে উঠে তালবিয়া পড়বেন। অর্থাৎ আপনার কাজ একটাই— বেশি বেশি তালবিয়া পড়া।
দোয়া পড়া
রাসূল (সা.) প্রদর্শিত সফর-সংক্রান্ত যত দোয়া আছে, প্রতিটি দোয়া পড়বেন ইনশাআল্লাহ।
সফর আরম্ভ (দোয়া)
১. সফর আরম্ভ করার জন্য আপনার পরিবার-পরিজন যাঁদের রেখে যাবেন, তাঁদেরকে রাসূল (সা.) যে দোয়াটি শিখিয়ে দিয়ে গেছেন, তাঁদের জন্য আপনি সে দোয়াটি করবেন। (আসতাওদি উকুমুল্লাহাল্লাজি লা তাদিউ ওয়া দায়িউহু)
২. আপনার পরিবারের সদস্য যাঁরা আছেন, তাঁরাও আপনার জন্য দোয়া করবেন। তাঁরা যে দোয়াটি করবেন, আপনার কাজ হবে ওই দোয়া যত দ্রুত সম্ভব তাঁদের লিখে দেবেন এবং তাঁরা আপনার জন্য সে দোয়াটি করবেন। (আসতাওদি উল্লাহা দিনাকা ওয়া আমানাতাকা ওয়া খাওয়াতিমা আমালিকা। যাও ওয়াদাকাল্লাহু তাকওয়া ওয়া গাফারা লাকা যাম্বাকা ওয়া ইয়াসসির লাকাল খাইরা)
৩. যখন ঘর থেকে বের হবেন, রাসূল (সা.)-এর দেখানো দোয়াটি পড়বেন। এই দোয়া আমরা মোটামুটি সবাই জানি। (বিসমিল্লাহি তাওয়াক্বালতু আলাল্লাহ, লা-হাওলা ওয়ালা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ)
৪. এর পর বাহনে উঠে আপনি হজক্যাম্প বা বিমানবন্দরে যাবেন। বাহনে উঠে রাসূল (সা.) যে দোয়া দেখিয়ে দিয়েছেন, অবশ্যই সে দোয়া পড়বেন। মনে রাখতে হবে, এই দোয়াগুলো হজের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এই দোয়াগুলো সফরের সঙ্গে সম্পর্কিত। যেহেতু এই সফর আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ সফর, সুতরাং অবশ্যই আপনি একটি দোয়াও বাদ দেবেন না। (আল্লাহুম্মা ইন্নি আ'উযুবিকা আন আদিল্লা আও উদাল্লা, আও আযিল্লা আও উযাল্লা, আও আজলিমা আও উজলামা, আও আজহালা আও ইউজহালা 'আলাইয়া।)
যানবাহনের দোয়াটি পড়ে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়ে চারটি জিনিস প্রার্থনা করবেন।
- আপনি যেন কাউকে পথভ্রষ্ট না করেন, আপনাকে যেন কেউ পথভ্রষ্ট না করে।
- আপনি যেন কাউকে পদস্থলিত না করেন, আপনাকে যেন কেউ পদস্থলিত না করে।
- আপনি যেন কারো সঙ্গে অন্যায় আচরণ না করেন, আপনার সঙ্গে যেন কেউ অন্যায় আচরণ না করে।
- আপনি যেন কারো সঙ্গে মূর্খতাপূর্ণ আচরণ না করেন, আপনার সঙ্গে যেন কেউ মূর্খতাপূর্ণ আচরণ না করে।
আপনি ইচ্ছা করলে আরো বেশি সফরের দোয়া পড়তে পারেন। এরপর ইনশাআল্লাহ আপনি হজক্যাম্প বা বিমানবন্দরে পৌঁছে যাবেন।
বিমানবন্দরে করণীয়
বিমানবন্দরে পৌঁছে প্রথম কাজটি হবে হজ এজেন্সি বা মুয়াল্লেম বা গাইডের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। এরপর দলবদ্ধ হবেন, বোর্ডিং পাস নেবেন, ইমিগ্রেশন শেষ করবেন, চেকইন করবেন এবং বিমানে উঠবেন। বিমানে ওঠার সময় আপনাকে ধৈর্য ধারণ করতেই হবে। হজের অন্যতম বিষয় ধৈর্যধারণ করা।
বিমানে উঠে করণীয়
যখন বিমানে উঠবেন এবং সেটি যদি হজ ফ্লাইট হয়ে থাকে, তাহলে এয়ার হোস্টেজ বা এয়ার ক্রু আপনাকে বলে দেবে, ‘হাজি সাহেব, এটি হজ ফ্লাইট। আপনার বোর্ডিং কার্ডে যে নম্বরটা লেখা আছে, সেটি নিয়ে আপনার সুবিধামতো সিটে বসে যান।’ দয়া করে হজের বিমানে ওঠার পর সিট নিয়ে কারো সঙ্গে ঝগড়া করবেন না। ধৈর্য ধারণ করবেন এবং সিটে বসে যাবেন। আর যদি এহরামের ভেতরে ঢুকে থাকেন, তাহলে আপনার কাজ একটাই, বেশি বেশি তালবিয়া পড়তে থাকবেন। বিমানে বসার পর আপনাকে বিমান কর্তৃপক্ষ খাবার দিয়ে যাবে। এখানে সব খাবার হালাল। কিন্তু খাবারের ট্রের মধ্যে একটি প্যাকেটে দেখবেন ওয়েট টিস্যু পেপার আছে। এটি সুগন্ধিযুক্ত টিস্যু। যেহেতু সুগন্ধি এ সময় ব্যবহার করা যাবে না, তাই ওই টিস্যু ব্যবহার করতে পারবেন না যদি এহরামের ভেতর ঢুকে থাকেন।
আর যাঁরা কখনো বিমানে ওঠেন নাই বা উঠেছেন, তাঁরা অবশ্যই বিমানের টয়লেট ব্যবহার করা জেনে যাবেন। আপনার পাশে যদি কোনো বয়স্ক হাজি থাকেন, যিনি কখনোই বিমানে ওঠেন নাই, তাহলে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন এবং তাঁকে টয়লেট ব্যবহারের পদ্ধতি শিখিয়ে দেবেন। যাঁরা জানেন, তাঁরাও যদি এহরামের ভেতর ঢুকে থাকেন, বিমানের টয়লেটে ঢোকার পর সেখানে যদি তরল সাবান অথবা হ্যান্ডওয়াশ থাকে, তাহলে তা ব্যবহার করবেন না। কারণ, সেটি সুগন্ধযুক্ত। আপনার কেবিন ব্যাগের ভেতরে অবশ্যই টিস্যুরোল নিয়ে নেবেন, যাতে করে সেটি ব্যবহার করতে পারেন।