ঈদুল আজহা : ত্যাগই আনন্দের আসল উপকরণ

বছর ঘুরে আবার এলো মুসলিম উম্মাহর জাতীয় উৎসবের দ্বিতীয় পর্ব ‘ঈদুল আজহা’। ঈদ আর আজহা দুটি শব্দই আরবি ভাষা থেকে আগত। ঈদ-এর বাংলা অর্থ আনন্দ বা উৎসব। আর আজহা শব্দটির মূল উজহিয়াতুন, যার অর্থ পশু জবাই করা। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় উজহিয়াতুন বলতে জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সালাতুল ঈদ আদায় করার পর থেকে ১৩ তারিখ সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট শ্রেণির গৃহপালিত পশুর মধ্য হতে কোনো একটিকে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে তাঁরই নামে জবাই বা উৎসর্গ করাকে বোঝায়। বাংলা ভাষাভাষি মুসলিম সমাজে উৎসবটি কোরবানির ঈদ বা বকরা ঈদ নামেও পরিচিত। বস্তুত মহান আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত মনীষীদের আত্মত্যাগের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয় বেলায়েতের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। সে মতে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে খলিলুল্লাহ উপাধি অর্জনে জিনের বাঁকে বাঁকে আত্মত্যাগের দুরূহ কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে নিজের আত্মার বলিষ্ঠতা। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের ঔরসজাত পুত্রসন্তানকে আল্লাহর নামে কোরবানি করে প্রমাণ করেছেন যে, নিজ জীবনের সব কামনা-বাসনার ঊর্ধ্বে তাঁর কাছে আল্লাহর নির্দেশ পালন করাটাই পরম আনন্দের বিষয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর সে (ইসমাইল) যখন পিতার সঙ্গে চলাফেরার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইব্রাহিম তাকে বলল : বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমি তোমাকে জবাই করছি; এখন তোমার অভিমত কী সেটা ভেবে বল। সে বলল, পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী হিসেবে পাবেন। যখন পিতা-পুত্র উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহিম তাকে জবাই করার জন্য শায়িত করলেন। তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহিম! তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে! আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। (সুরা আস-সাফফাত : ১০২-১০৫)
হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে জবাই করেছিলেন নিজের পুত্রকে। আর মহান আল্লাহ ইসমাইলের স্থানে বেহেশতি জন্তু শুইয়ে দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন, তিনি ইবাদতের নামে মুসলিম সমাজে নরহত্যার জঘন্য প্রথা চালু করতে চান না। তিনি শুধু চান আস্তিকের আত্মার নিখাঁদ আনুগত্য। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর নিকট তোমাদের কোরবানির জন্তুর রক্ত-মাংস কিছুই পৌঁছায় না। তাঁর কাছে পৌঁছায় শুধু তোমাদের অন্তরের তাকওয়াটুকু। এভাবে তিনি এগুলোকে (জীব-জন্তুকে) তোমাদের অনুগত করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা কর। এ জন্য যে তিনি তোমাদের হেদায়েতের পথ দেখিয়েছেন। সুতরাং সৎকর্মশীলদেরকে সুসংবাদ শুনিয়ে দাও।’ (সুরা আল-হাজ : ৩৭) আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হজরত ইব্রাহিমের আত্মত্যাগের মহত্ত্বে মুগ্ধ হয়ে তাঁর সেই পুণ্যস্মৃতিকে অনাগত কিয়ামত পর্যন্ত সকল মুসলিম মানসে সজীব করে রাখার জন্য কোরবানি করাকে অপরিহার্য করে দিয়েছেন এবং এর অনুশীলনের দিনটিকে ইসলামের জাতীয় উৎসব হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। আর বিনিময়ে সীমাহীন সওয়াবের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে মুসলিম উম্মাহকে। হজরত জায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, একবার সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! কোরবানিটা কী? উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমাদের পিতা ইব্রাহিমের সুন্নত। সাহাবিরা আবার প্রশ্ন করলেন, এর বিনিময়ে আমাদেরকে কী দেওয়া হবে? তিনি বললেন, কোরবানির জন্তুর শরীরের প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে সওয়াব দেওয়া হবে। তারা আবারও প্রশ্ন করলেন, ভেড়ার ব্যাপারে কী করা হবে? তিনি বললেন, ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি করে সওয়াব প্রদান করা হবে। (মুসনাদে আহমাদ : ১৯২৮৩, সুনানে ইবনে মাজা : ৩১২৭, আল-মুজামুল কাবির : ৫০৭৫)
কোরবানি সম্পূর্ণভাবেই মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে অনুগত বান্দার আত্মত্যাগের স্মৃতিচারণা। তাই কোরবানি হতে হবে ভোগের লালসা ও লৌকিকতার কালিমামুক্ত আল্লাহর উদ্দেশে নিবেদিত। মহান এই সওয়াবের আমলটি যাতে সামর্থ্যের সকল স্তরের মুমিন পালন করতে পারে সে জন্য ছোট জন্তু যেমন ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা একজনের পক্ষ থেকে এবং বড় জন্তু যেমন উট, গরু বা মহিষে তিন ভাগে কোরবানি করা ইসলামী শরিয়ত বৈধ করেছে। হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমরা হোদাইবিয়ার সন্ধির বছরে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উপস্থিতিতে উট সাতভাগে এবং গরু সাতভাগে কোরবানি করেছিলাম। (মুআত্তা ইমাম মালেক : ৬৩৯) কোরবানি অবশ্যই হালাল উপার্জনের অর্থ দিয়ে এবং খাঁটি নিয়তে হতে হবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হে লোক সকল! তোমরা জেনে রেখ, নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্র এবং তিনি পবিত্র ছাড়া অপবিত্র কোনো কিছু গ্রহণ করেন না। (সহিহ মুসলিম : ১০১৫, মুসনাদে আহমাদ : ৮৩৪৮, মুসান্নেফে আবদুর রাজ্জাক : ৮৮৩৯)