পতনবাজারে শেয়ার কেনাবেচা নিয়ে যা বললেন বিশ্লেষকরা
দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) মন্দা পার করল গত সপ্তাহে। সপ্তাহটিতে পুঁজিবাজারে মূলধনসহ কমেছে লেনদেনের পরিমাণ। কমেছে ৮৩ শতাংশ কোম্পানির শেয়ার দর। মন্দার একই চিত্র ছিল আগের সপ্তাহে। ঈদের আগে পুঁজিবাজারে এ ধরনের মন্দায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বিনিয়াগকারীরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানের মন্দার কারণে গেল সপ্তাহে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স পাঁচ হাজার ৭৬২ পয়েন্টে নেমে এসেছে। এ ধরনের কম পয়েন্টের সূচক গত ৩৫ মাস ১৫ দিনের মধ্যে দেখেনি বিনিয়োগকারীরা। আবার বাজারে মূলধনের পরিমাণ কমেছে ১৩ হাজার ৩১১ কোটি টাকা। এতে অনেক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতেও লোকসানে শেয়ার বিক্রি না করে ধৈর্য ধরতে বললেন। পাশাপাশি কম দরে শেয়ার কেনার পরামর্শ দিলেন তারা।
আরও পতন হবে, এমন গুজব ছড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত করতে চাচ্ছে একটি চক্র জানিয়ে তারা বলছেন, তাদের (চক্র) ইচ্ছে, বাজারে পতনের ভয় দেখিয়ে কম দরে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার হাতিয়ে নেওয়া। তাই এমন অবস্থায় বুঝে ও বিশ্লেষণে শেয়ার বেচার পরামর্শ দেন।
গেল সপ্তাহ মন্দায় কাঁটল পুঁজিবাজার জানিয়ে লঙ্কাবংলা, রয়েল সহ আরও তিন সিকিউরিটিজ হাউজের অন্তত ১০ কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান সময়টা ভাল যাচ্ছে না আমাদের। এই বাজারের প্রায় ৮০ শতাংশ কোম্পানির শেয়ার দর কমতির দিকে রয়েছে। সামনে ঈদ, আর ঈদের আগে এ ধরনের মন্দা অবস্থায় হতাশায় কাটছে বিনিয়োগকারীদের। তবে এটা সত্যি যে, এ ধরনের কম দরের শেয়ার উত্থান বাজারে পাওয়াটা মুশকিল। অপরদিকে পিই রেশিও হিসেবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ নিরাপদ অবস্থানে রয়েছে। তাই আমাদের পরামর্শ থাকবে, যাদের অলস অর্থ পড়ে আছে, তারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করুন। কম দরে শেয়ার কিনুন। কারণ পতন বাজার বিনিয়োগের জন্য উত্তম।
মন্দায় বাজারে শেয়ার বিক্রি না করে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আল আমিন বলেন, কিছুদিন আগেও গড় লেনদেন ছিল চৌদ্দ-পনেরশ কোটি টাকার ওপরে। বর্তমানে সেই লেনদেন চার-পাঁচশ কোটি টাকার ঘরে। সূচক পতন হয়েছে অস্বাভাবিকহারে। প্রতিদিনই কমছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর। পুঁজিবাজারের এই মন্দায় বুঝে শুনে বেচাকেনা করতে হবে।
ঈদের আগে অস্বাভাবিক পুঁজিবাজার পতন, সময়টা ভালো না বিনিয়োগকারীদের জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, তড়িঘড়ি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। হুটহাট শেয়ার কেনাবেচা থেকে বিরত রাখুন। ধৈর্য ধরুন। কান কথা শুনে কোন শেয়ার কিনবেন না। লোকসানেও শেয়ার বিক্রি করবেন না।
পতন বাজার বিনিয়োগের জন্য ভালো সময় জানিয়ে ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, শেয়ারবাজারে উত্থান পতন থাকবে। এটাই নিয়ম। তবে, পতন বাজারে শেয়ার লসে বিক্রি না করে বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধরতে হবে।
এদিক গত ১০ অক্টোবর পুঁজিবাজারে সরকারি বন্ডের লেনদেন শুরু হয়। এরপর ডিএসইতে ২৫০ বন্ডের লেনদেন হয়। এতে ডিএসইর শেয়ারবাজার মূলধন ২ লাখ ৫২ হাজার ২৬৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা বেড়ে ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৩৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছিল। এরপর গত ২৭ অক্টোবর শেয়ারবাজার মূলধন কমে দাঁড়িয়েছিল সাত লাখ ৬৯ হাজার ৪৬৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা। গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার শেয়ারবাজার মূলধন দাঁড়ায় ছয় লাখ ৭৯ হাজার ২২৯ কোটি টাকায়। আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবারে শেয়ারবাজারে মূলধন দাঁড়িয়েছিল ছয় লাখ ৯২ হাজার ৫৪০ কোটি টাকায়।
গেল সপ্তাহে ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে এক হাজার ৯৭৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল এক হাজার ৯৮৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা। ডিএসইতে প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয়েছে ৪৯৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে গড়ে লেনদেন হয়েছিল ৪৯৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা। গেল সপ্তাহে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত ৪১১টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়। এর মধ্যে শেয়ার দর বেড়েছে ৩৫টির, দর কমেছে ৩৪৩টির ও অপরিবর্তিত রয়েছে ১৫টি কোম্পানির। লেনদেন হয়নি ১৮টি কোম্পানির শেয়ার।
সপ্তাহে সব ধরনের সূচক পতনে লেনদেন শেষ হয়। এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৬৩ দশমিক ৩৪ পয়েন্ট কমে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৭৭৮ দশমিক ৩৩ পয়েন্টে। শরিয়াহ সূচক ডিএসইএস ৩৮ দশমিক ৪৯ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ২৫৪ দশমিক ৫৪ পয়েন্টে। এ ছাড়া ডিএসই৩০ সূচক ৪৬ দশমিক ৬৩ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ১১ দশমিক শূন্য ৯ পয়েন্টে।
গেল সপ্তাহে লেনদেন শীর্ষ ১০টি কোম্পানি লেনদেন হয়েছে ৬৬০ কোটি ৫১ লাখ টাকার শেয়ার। কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয় ‘এন’ ক্যাটাগরির এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের শেয়ার। কোম্পানিটি একাই মোট শেয়ারের লেনদেন হয় ১১৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা বা পাঁচ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
এদিকে গেল সপ্তাহের শেষে (বৃহস্পতিবার) ডিএসইর পিই রেশিও অবস্থান করে ১১ দশমিক ৬৪ পয়েন্টে। আগের সপ্তাহের শেষে (বৃহস্পতিবার) পিই রেশিও দাঁড়িয়েছিল ১২ দশমিক ২৪ পয়েন্টে। পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারে কোনো কোম্পানির পিই রেশিও ১৫ পয়েন্ট ছাড়ালেই তা বিনিয়োগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। অন্যদিকে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) মার্জিন ঋণের যোগ্যতা হিসেবে সর্বোচ্চ ৪০ পিই রেশিও বেঁধে দিয়েছে। এ হিসেবে ৪০ পর্যন্ত পিইধারীর শেয়ার বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ বলে জানায় বিএসইসি। সেই হিসেবে গত বৃহস্পতিবারের ডিএসইর পিই রেশিও হিসাবে বিনিয়োগ নিরাপদ অবস্থানে রয়েছে।