বিনিয়োগকারীদের হাহাকারে বছর পার
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে বিনিয়োগ শুরু করলেও ২০২৪ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ডুবে ছিল হতাশায়। কোনোভাবেই যেন বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশার ধারেকাছে যায়নি বছরটি। ডিএসইতে সূচক ধস, অধিকাংশ কোম্পানির দরপতনসহ মূলধন হ্রাস ছিল অব্যাহত। এসব কারণে বছরজুড়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ছিল পুঁজি হারানোর হাহাকার।
ডিএসইর সার্বিক মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও) ৯ থেকে ১২ পয়েন্টে মধ্যে ছিল। যদিও পিই রেশিও হিসেবে ডিএসইতে বিনিয়োগ ক্ষেত্রে এটা (৯ থেকে ১২ পয়েন্ট) নিরাপদেই ছিল। তবুও বছরটিতে পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ছিল না বললেই চলে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে বিএসইসির শীর্ষ পদে ব্যাপক রদবদল আনা হয়। এতে বিদায় নেন শিবলী রুবাইয়াত-উল–ইসলাম কমিশন। পরে খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে প্রধান করে গঠন হয় বিএসইসির নতুন কমিশন। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে ডিএসই ও সিএসইর (চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ) পর্ষদ পুরোটাই রদবদল হয়। এরপরও পুঁজিবাজারের প্রতি আস্থা ফেরেনি। এতে বিনিয়োগকারীরাও খুবই ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। ফলে বিনিয়োগকারীরা লংমার্চসহ আগারগাঁওয়ে বিএসইসি কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেন। একইসঙ্গে বিএসইসি কার্যালয়ের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন। এ ছাড়া বিএসইসির চেয়ারম্যানের পদত্যাগও দাবি করেন তারা।
এমন একপর্যায়ে বিএসইসি নতুন কমিশন নড়েচড়ে বসে। সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে পুঁজিবাজারের স্বার্থে বেশকিছু পদক্ষেপ নেন নতুন কমিশন। এতে কারসাজির অভিযোগে অনেকে শাস্তি দেন। এ ছাড়া বাজারের স্বার্থে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এর কাজ এখনও চলমান। আশা করা যাচ্ছে, সামনের বছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য ভাল কিছু আসবে।
শেখ হাসিনা পতনের পর বাজারে বিনিয়োগে নতুন আশায় জেগেছিল বিনিয়োগকারীদের মনে—এমনটা জানিয়ে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলেন, শুরুতে পুঁজিবাজারে বেশ চাঙ্গা ছিল। কিন্তু সেই চাঙ্গা ধরে রাখতে পারেনি। এতে আশাহত হোন বিনিয়োগকারীরা। তারা বলেন, ২০২৪ সালের সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ১৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ। বাজারে মূলধন কমেছে ১৫ দশমিক ১৪ শতাংশ। তবে, লেনদেন বেড়েছে পাঁচ দশমিক ৩৭ শতাশ। একইসঙ্গে মোবাইল লেনদেন বেড়েছে ১৪ শতাংশ।
অন্যান্য সালের চেয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল এবারের ২০২৪ সাল জানিয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম বলেন, এটা ছিল একটি ঘটনাবহুল বছর। অনেক আপ-ডাউন হয়েছে। এর মধ্যে নতুন কমিশনের চেষ্টায় একটা অবস্থানে এসেছি। পুঁজিবাজারের স্বার্থে কমিশন নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, ২০২৫ সালে তার ইতিবাচক ফল পাব।
২০২৪ সালের প্রথম সাত মাস শেখ হাসিনার সরকার ছিল, তখন পুঁজিবাজার প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা তলানিতে জানিয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আল আমিন বলেন, আলোচিত প্রথম সাত মাসে পুঁজিবাজার অনিয়মে ঢাকা ছিল, ছিল কারসাজিকারীদের দখলে। বাজার মনিটরিং ছিল দুর্বল। ফলে পুঁজিবাজার রুগ্ন হয়ে পড়েছিল। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। পরে বিএসইসিতে ব্যাপক রদবদল হয়। নতুন করে ঢেলে সাজানো হয় বিএসইসিকে।
পুঁজিবাজারের উন্নয়ন স্বার্থে গত চার মাস নতুন কমিশন বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে জানিয়ে আল আমিন বলেন, বাজারে কারসাজি রোধ করা হচ্ছে। অনিয়মকারীদের শাস্তি আওতায় আনা হচ্ছে। এরইমধ্যে বিএসইসি সংস্কার করা হচ্ছে। পুঁজিবাজারের স্বার্থে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, যার কাজ চলমান রয়েছে। আশা করছি, আগামী বছরের জুনের মধ্যে পুঁজিবাজার ইতিবাচক দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যার ফল বিনিয়োগকারীরা পাবে।
২০২৪ সালের চিত্র
সূচক : ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারির শুরুতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল ছয় হাজার ২৪৬ পয়েন্ট। বছরটির শেষে ৩০ ডিসেম্বর তা দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ২১৬ পয়েন্টে। এক বছরের ব্যবধানে ডিএসইএক্স কমেছে এক হাজার ৩০ পয়েন্ট ১৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ। বছরটিতে ডিএসইএক্স সবোর্চ্চ ওঠেছিল ছয় হাজার ৪৪৭ পয়েন্ট। সর্বনিম্নে নেমেছিল চার হাজার ৮৯৮ পয়েন্ট।
গত ১ জানুয়ারির শুরুতে ডিএসইর সূচক ডিএস৩০ ছিল দুই হাজার ৯৩ পয়েন্ট। বছরটির শেষে ৩০ ডিসেম্বর তা দাঁড়ায় এক হাজার ৯৩৯ পয়েন্টে। এক বছরের ব্যবধানে ডিএস৩০ কমেছে ১৫৪ পয়েন্ট সাত দশমিক ৩৬ শতাংশ। বছরটিতে ডিএস৩০ সবোর্চ্চ ওঠেছিল দুই হাজার ১৯৭ পয়েন্ট। সর্বনিম্নে নেমেছিল এক হাজার ৮০৩ পয়েন্ট।
গত ১ জানুয়ারির শুরুতে ডিএসইর সূচক ডিএসইএস ছিল এক হাজার ৩৬৪ পয়েন্ট। বছরটির শেষে ৩০ ডিসেম্বর তা দাঁড়ায় এক হাজার ১৬৮ পয়েন্টে। এক বছরের ব্যবধানে ডিএসইএস কমেছে ১৯৬ পয়েন্ট বা ১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ। বছরটিতে ডিএসইএস সবোর্চ্চ ওঠেছিল দুই হাজার ১৯৭ পয়েন্ট। সর্বনিম্ন নেমেছিল এক হাজার ৮০৩ পয়েন্ট।
মূলধন : গত ১ জানুয়ারি শুরুতে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছিল সাত লাখ ৮০ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা। এখন তা কমে ৩০ ডিসেম্বর দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ৬২ হাজার ৬১৯ কোটি টাকায়। এক বছরের ব্যবধানে ডিএসই বাজার মূলধন কমেছে এক লাখ ২২ হাজার ২৩০ কোটি টাকা বা ১৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
আইপিও : ২০২৪ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে চার কোম্পানি ৬১৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে এনআরবি ব্যাংক ১০০ কোটি টাকা, বেস্ট হোর্ডিং ৩৫০ কোটি টাকা, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ ৯৫ কোটি টাকা এবং টেকনো ড্রাগস ১০০ কোটি টাকার সংগ্রহ করেছে। আগের বছর ২০২৩ সালে আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে পাঁচ কোম্পানি ৪০৪ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছিল।
লেনদেন : ২০২৪ সালে ডিএসইতে লেনদেন হয়েছিল এক লাখ ৪৮ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা। আগের বছর ২০২৩ সালে লেনদেন ছিল এক লাখ ৪১ হাজার ৫৯ কোটি টাকায়। এক বছরের ব্যবধানে লেনদেন বেড়েছে সাত হাজার ৫৮০ কোটি টাকা বা পাঁচ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
মোবাইল লেনদেন : ২০২৪ সালে মোবাইলে লেনদেন হয়েছিল ২১ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। আগের বছর ২০২৩ সালে লেনদেন ছিল ১৬ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে মোবাইলে লেনদেন বেড়েছে চার হাজার ৪৫১ কোটি টাকা বা ১৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
ব্লক মার্কেট : ২০২৪ সালে ব্লক মার্কেটে লেনদেন হয়েছিল ৯ হাজার ২৫১ কোটি টাকা। আগের বছর ২০২৩ সালে লেনদেন হয়েছিল ১৪ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে ব্লক মার্কেটে লেনদেন কমেছে চার হাজার ৯২৬ কোটি টাকা বা ৩৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
এসএমই মার্কেট : ২০২৪ সালে এসএমই মার্কেটে লেনদেন হয়েছিল তিন হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। আগের বছর ২০২৩ সালে লেনদেন হয়েছিল এক হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এসএমই মার্কেটে লেনদেন বেড়েছে এক হাজার ৬০৫ কোটি টাকা বা ৮৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
এসএমই ব্লক মার্কেট : ২০২৪ সালে এসএমই ব্লকে মার্কেটে লেনদেন হয়েছিল ৮৩২ কোটি টাকা। আগের বছর ২০২৩ সালে লেনদেন হয়েছিল ৭৫ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এসএমই ব্লকে মার্কেটে লেনদেন বেড়েছে ৭৫৭ কোটি টাকা বা এক হাজার সাত শতাংশ।
এটিবি : ২০২৪ সালে অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ডে (এটিবি) লেনদেন হয়েছিল ১০৫ কোটি টাকা। আগের বছর ২০২৩ সালে লেনদেন হয়েছিল ৬৭ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এটিবির লেনদেন বেড়েছে ৩৮ কোটি টাকা বা ৫৬ হাজার ৭২ শতাংশ।
জি-সেকেন্ড : ২০২৪ সালে জি-সেকেন্ড লেনদেন হয়েছিল ১৩০ কোটি টাকা। আগের বছর ২০২৩ সালে লেনদেন হয়েছিল ৮৪ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে জি-সেকেন্ড বেড়েছে ৪৬ কোটি টাকা বা ৫৪ হাজার ৮০ শতাংশ।
টাস্কফোর্স গঠন : পুঁজিবাজার উন্নয়নে পাঁচ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করেছে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার। ব্যাংক ঋণের বদলে পুঁজিবাজার থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে সরকারের নীতি প্রণয়ন এবং এ সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিএসইসির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের সুপারিশ করাসহ টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭টি। যৌক্তিক সময়ের মধ্যে টাস্কফোর্স তাদের সুপারিশসহ প্রতিবেদন কমিশনে হস্তান্তর করবে।