বর্ণবাদী বিতর্কে অবরুদ্ধ ক্রিকেট
শুরু করার আগে বলে নিই, বাসিল ডি অলিভেয়রাকে চেনেন তো? ওই যে, কেবল ক্রিকেট খেলার জন্য জন্মভূমি ত্যাগ করেছিলেন যিনি। কেপটাউনের হয়ে একটি ম্যাচে মাত্র ৭০ মিনিট ব্যাটিং করেন এই অলিভেয়রা। ১০টা চার আর ২৬টি ছয়ে একাই করেন ২২৫ রান। জানেন, তাঁর দল কত রান করেছিল? ২৩৬! এক ওভারে ৪৬ রান তুলে নিজেকে অন্য পর্যায়ের ক্রিকেটারে পরিণত করতে পেরেছিলেন তিনি। যখন তাঁর বয়স ২৯, ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর শতকের সংখ্যাটা শুনলে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যাবে আপনার! ঘরোয়া ক্রিকেটে অতুটুক বয়সে ৮২টি সেঞ্চুরি করে ফেলেছিলেন তিনি। একটা সময় তাঁকে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটের ‘ওয়ালি হ্যামন্ড’ বলা হতো। তবে দেশের হয়ে কখনই ক্রিকেট খেলা হয়নি তাঁর। কারণ, তাঁর গায়ের রং যে কালো ছিল। ক্রিকেটের টানে শেষ পর্যন্ত বয়স লুকিয়ে ইংল্যান্ডে খেলতে আসেন তিনি। এটাই ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার অবস্থা।
বর্ণবাদী নীতির কারণে প্রোটিয়া জাতীয় দলে কালোদের ঠাঁই হতো না। তাই অলিভেয়রারও জায়গা হয়নি নিজের দেশের ক্রিকেট দলে। ১৯৪৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষমতা দখল করে শ্বেতাঙ্গ সরকার, যাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোই ছিল ‘অ্যাপার্টহিড’ বা ‘জাতিবিদ্বেষ’! শ্বেতাঙ্গদের জন্যেই ছিল সকল সুবিধা। এভাবেই প্রায় দেড় যুগ অতিবাহিত হয়। ১৯৬৪ সালে বর্ণবাদী এই নিয়মের গোড়ায় প্রথম আঘাতটা করে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি। সেবার টোকিও অলিম্পিকে ৬২ জনের অলিম্পিক দল পাঠায় দক্ষিণ আফ্রিকা। যাঁদের একজনও কালো বর্ণের মানুষ ছিল না। প্রতিবাদ করল অলিম্পিক কমিটি। কোটাপ্রথা মানতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৫০ দিনের সময় দেওয়া হলো। তবে অলিম্পিক কমিটির সুপারিশ মানেনি দেশটি। এর ফলে অলিম্পিক থেকে নিষিদ্ধ হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। সে বছরই ফিফাও নিষিদ্ধ করে দেশটিকে। বাকি ছিল কেবল ক্রিকেট।
ক্রিকেটে তত দিন দক্ষিণ আফ্রিকার ভিত দাঁড়িয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের মতো দেশগুলো প্রতিবছরই দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে আসে। তাই ক্রিকেটটা বহুদিন সচল ছিল সেখানে। তবে এবারও বাগড়া দেন নেই অলিভেয়রা। ১৯৬৮ সালে দিক্ষণ আফ্রিকা সফরে আসার কথা ছিল ইংল্যান্ডে। বাসিল ডি অলিভেয়রা তখন ইংল্যান্ড জাতীয় দলের তারকা। হিসাবমতো তাঁরও সেই সফরে আসার কথা। তবে আফ্রিকা সরকার জানিয়ে দিল, তারা কোনো কালো ক্রিকেটারকে আতিথেয়তা দেবে না। ব্যস, শুরু হয়ে গেল প্রতিবাদ। শেষ পর্যন্ত বাতিল হয় ইংল্যান্ডের সেই সফর।
বর্ণবাদী নীতির কারণে শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ক্রিকেটের প্রতিটি দেশই প্রোটিয়াদের নিষিদ্ধ করার পক্ষে ভোট দেয়। এর ফলে ক্রিকেট থেকে কার্যত নিষিদ্ধ হয়ে গেল দেশটি। অথচ আগের সিরিজেই মহাপরামশালী অস্ট্রেলিয়াকে ৪-০ তে হোয়াইটওয়াশ করেছিল প্রোটিয়ারা।
২১ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পর একজন কালো মানুষের অনুরোধে আবার ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। তিনি নেলসন ম্যান্ডেলা।
১৯৯১ সালে একজন সাংবাদিক ম্যান্ডেলার কাছে জানতে চান, দক্ষিণ আফ্রিকার আবার ক্রিকেটে ফেরা উচিত কি না। জবাবে মাদিবা বলেন, ‘অবশ্য আমাদের ক্রিকেটে ফেরা উচিত। আমার মনে হয়, এ নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। পরদিন বিশ্ব গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয় ম্যান্ডেলার বক্তব্য।
মানবতাবাদী মাদিবার অনুরোধ ফেলতে পারেনি আইসিসি। ১৯৯২ সালে বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য শারজায় এক বৈঠক হয়। সেখানেই দক্ষিণ আফ্রিকার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছাড়া বাকি সব দেশই প্রেটিয়াদের ক্রিকেটে স্বাগত জানায়। এরপর আবার ক্রিকেটে ফিরে দক্ষিণ আফ্রিকা।
এত অবতরণিকা টানার কারণ আজ ১০ মার্চ। ১৯৭১ সালের আজকের দিনই নিজেদের শেষ টেস্ট ম্যাচটা খেলে দক্ষিণ আফ্রিকা। এরপই ২১ বছরের নিষেধাজ্ঞা নেমে আসে দেশটির ওপর।