ব্যাটসম্যানদের পরীক্ষার বিশ্বকাপ

Looks like you've blocked notifications!
শচীন টেন্ডুলকার

উপমহাদেশের বাইরে ভারতের জাতীয় দলের সঙ্গে আমি প্রথম খেলতে যাই নিউজিল্যান্ডে, ১৯৯০ সালে। সর্বকালের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার রিচার্ড হ্যাডলির বিপক্ষে খেলার জন্য আমি মুখিয়ে ছিলাম। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কিংবদন্তিদের কাছ থেকে কোনো বিশেষ সুবিধা পাওয়ার আশা কখনোই করিনি। আমার দলের অন্য ব্যাটসম্যানদের মতো আমিও প্রতিপক্ষের বোলারদের তোপের মুখে পড়েছিলাম। নিউজিল্যান্ডে আমার প্রথম ইনিংসে ড্যানি মরিসনের বলে আউট হয়েছিলাম। শূন্য রানে এবং প্রথম বলেই! আমাকে একটা ‘যথাযথ’ বিদায় দিতে কিউইরা কোনো কার্পণ্য করেনি। বলা বাহুল্য, ভীষণ বিব্রত হয়েছিলাম সে সময়।

অস্ট্রেলিয়ায় আমার প্রথম সফর ছিল পরের বছর, ১৯৯১ সালে। ১৯৯২ আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপের ঠিক আগে। ওই সফর দিয়েই সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের সঙ্গে আমার মধুর সম্পর্কের সূত্রপাত। ভারতের বাইরে এটাই আমার সবচেয়ে প্রিয় ভেন্যু। এ কারণে সেই সফরটা বিশেষ কিছু ছিল। অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় তারকা শেন ওয়ার্নের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সূচনাও তখন থেকে। ওই সফরে ব্যাটিংয়ে আমার আদর্শ ভিভ রিচার্ডসের দেখাও পাই প্রথমবারের মতো। সেই সাক্ষাতের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র তিন মিনিট। কিন্তু আমার জন্য সেটা ছিল ভীষণ রোমাঞ্চকর ঘটনা।

সে সফরেই আমি ব্যাকফুট পাঞ্চ খেলায় পারদর্শী হয়ে উঠি। উচ্চতার কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ায় আমি বাউন্সারগুলো খেলতাম ওপর থেকে। কিছুটা পেছনে গিয়ে পাঞ্চ করতাম সোজা ব্যাটে। আর জায়গা পাওয়া গেলে অবশ্যই খেলতাম কাট শট। কিন্তু ব্যাকফুট পাঞ্চটা ছিল অনেক বেশি বৈচিত্র্যময়। গুড লেংথ বলেও এই শট খেলা যেত, আর সেটা বোলারদের কাজ আরও কঠিন করে তুলত।

এই শট খেলে অনেক রান পেয়েছি। টাইমিং ঠিকমতো হলে বল চলে যেত বাউন্ডারি লাইনের বাইরে। এমনকি রক্ষণাত্মক শটের ক্ষেত্রেও পায়ের আঙুলের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে বলগুলো খেলতে পারতাম। সাধারণ একটা রক্ষণাত্মক শটের চেয়ে এই শট একটু ভিন্নই ছিল।

নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড আমার জন্য একটি বিশেষ জায়গা। ১৯৯৪ সালে সেখানেই ওয়ানডেতে উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলা শুরু করেছিলাম। এই পজিশনটা আমি পুরো ক্যারিয়ারেই উপভোগ করেছি।

উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলার আগ্রহ সব সময়ই ছিল। কারণ, আমি শুরু থেকেই বোলারদের ওপর চড়াও হয়ে খেলতে পারতাম। আর শুরুর দিকের ওভারগুলোতে ফিল্ডিং সীমাবদ্ধতার ফায়দাও নিতে পারতাম। ১৯৯১-৯২ মৌসুমে নিউজিল্যান্ডের বাঁহাতি ব্যাটসম্যান মার্ক গ্রেটব্যাচ ওপেনার হিসেবে এই কাজে দারুণ সাফল্য পেয়েছিলেন। আর আমিও নিশ্চিত ছিলাম যে নিজের দেশের জন্য একই কাজ করতে পারব।

আমি সব সময়ই চেয়েছি, শুরু থেকে বোলারদের ওপর চড়াও হয়ে খেলে তাদের ছন্দ নষ্ট করে দিতে। এখনও মনে পড়ে, উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে এসে আক্রমণাত্মক শট খেলার দৃশ্যগুলো। চেষ্টা করতাম বোলারদের লেংথ তছনছ করে দেওয়ার। আর তার পর অপেক্ষা করতাম শর্ট বলের জন্য!

পার্থ আর ব্রিসবেন দ্রুতগতির বাউন্সি উইকেটের জন্য বিখ্যাত। এ দুই মাঠে অনভিজ্ঞরা খুব সহজেই সমস্যায় পড়ে যেতে পারে। ব্যাটসম্যান-বোলার কারোরই ভুল করার কোনো অবকাশ নেই। ব্যাটসম্যান হিসেবে আপনি যদি বলের পেস আর বাউন্স বুঝে যান, তাহলে বোলারদের ওপর আধিপত্য করতে পারবেন। আর বোলারদের বলব, অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের উইকেটে গুড লেংথ ‘স্পট’ বেশ ছোট। তাই লাইন-লেংথে একটু গড়বড় হলেই ব্যাটসম্যানরা তার ফায়দা তুলতে পারে। কিন্তু বোলাররা গুড লেংথে বল রেখে বাউন্স আদায় করতে পারলে ব্যাটসম্যানদের কাজ অনেক কঠিন হয়ে যায়।

নিউজিল্যান্ডের কয়েকটি মাঠের বাতাস সম্পর্কেও ব্যাটসম্যানদের সজাগ থাকতে হবে। কখনো কখনো বাতাস এত জোরে বয়ে যায় যে সেটা ব্যাটসম্যানের টাইমিংয়ে বিরূপ প্রভাব ফেলে। বাতাসের বিপরীতে খেলার সময় ব্যাটসম্যানের ব্যাক লিফট দ্রুত হতে হয়। কিন্তু ব্যাট নামাতে হয় অপেক্ষাকৃত ধীরে। উইকেটের এক প্রান্তে বল আসে অনেক দ্রুতগতিতে। অপর প্রান্তে ঘটে উল্টো ঘটনা।

নিউজিল্যান্ডের মাঠগুলোর আরেকটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য, অনেকগুলোই ঠিক প্রথাগত গোল আকৃতির নয়। অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড ওভালের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। এই মাঠগুলোতে পয়েন্ট আর স্কয়ার লেগ অঞ্চলের সীমানা বেশ ছোট হয়। আর পিচের দুই প্রান্তের সীমানা তুলনামূলক বড় হয়। সফরকারী দলকে এটা বেশ সমস্যায় ফেলে দেয়। কারণ, এ ধরনের মাঠ ফিল্ডিং সাজানো ও বোলিং কৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভালোই প্রভাব ফেলে।

অস্ট্রেলিয়ার বড় মাঠগুলোর সীমানা তো একেবারে বিশাল। মনে পড়ছে, ১৯৯৯ সালে দৌড়ে চার রান নেওয়ার কথা। বাউন্ডারি লাইনে ছিলেন রিকি পন্টিং। তিনি যখন বল ছুড়লেন, আমি চতুর্থ রানের জন্য আহ্বান জানিয়েছি সতীর্থ ব্যাটসম্যানকে। পন্টিংয়ের শক্তিশালী হাতের কথা জানার পরও আমরা দৌড়েছিলাম। কারণ জানতাম, বল উইকেটরক্ষকের হাতে এসে পৌঁছাতে কিছুটা সময় লাগবেই। এখন অবশ্য সীমানা কিছুটা ছোট করা হয়েছে; কিন্তু তার পরও সেগুলো বেশ বড়ই।

যেসব ব্যাটসম্যান ছন্দে নেই, তাঁদের ৩০ গজ বৃত্তের মধ্যে অতিরিক্ত ফিল্ডারের উপস্থিতি সমস্যায় ফেলতে পারে। সে ক্ষেত্রে এক রান নিয়ে দিক পরিবর্তন করে অন্য প্রান্তের ব্যাটসম্যানকে ‘স্ট্রাইক’ দেওয়া তাঁর জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে একটা কথা অবশ্য বলতে চাই। ক্রিজে একই সঙ্গে যদি দুজন ছন্দে থাকা ব্যাটসম্যানকে আমরা দেখতে পাই? তাহলে বলব, ঈশ্বর যেন বোলারদের রক্ষা করেন!

--------------------------------------------------

শচীন টেন্ডুলকার : টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রান ও শতকের মালিক। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০০টি শতক করা একমাত্র ব্যাটসম্যান। ওয়ানডেতে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিও তাঁর। ভারতের পক্ষে ছয়টি বিশ্বকাপ খেলেছেন। শিরোপা জিতেছেন একবার, ২০১১ সালে। ১৯৯৬ ও ২০০৩ বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি রানও টেন্ডুলকারের।

লেখাটি বুধবার ১১ ফেব্রুয়ারি আইসিসির অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত। ভাষান্তর পার্থ প্রতীম দাস