মুস্তাফিজদের বাড়িই যেন মিরপুর স্টেডিয়াম

Looks like you've blocked notifications!
বাংলাদেশের হয়ে ভারতের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে জয়ের নায়ক মুস্তাফিজুর রহমান উজ্জ্বল দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও। আজ রোববার মিরপুরে শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে ভারতের ব্যাটসম্যান সুরেশ রায়নাকে নিজের পঞ্চম শিকারে পরিণত করে মুস্তাফিজের উল্লাস। ছবি : এএফপি

বাড়ি থেকে সাড়ে চারশ কিলোমিটার দূরে মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম। বাড়ির ছোট ছেলেটি খেলছেন সেখানে। সেই ছেলেটি যিনি পড়া ফেলে সারাদিন ধুলো-কাদা মেখে মাঠে পড়ে থাকতেন! সেই ছেলেটি যিনি খেলা শেষে ফেরার সময় ভাইয়ের মোটরসাইকেলের পেছনে ঘুমিয়ে পড়তেন! নিজের সাথে বেঁধে বড় ভাই বাড়ি নিয়ে আসতেন!

তাঁর বাড়িতে কখনো খুব একটা মানুষ দেখা যেত না। কিন্তু আজ সেই বাড়িতে ভিড় করেছে এলাকার সবাই! হবেই না বা কেন? সেই ছেলেটি তো এখন গোটা দেশেরই চোখের মণি। তাঁর নাম মুস্তাফিজুর রহমান। লিকলিকে যে পেসারের ধাক্কায় পড়ে গেছে সুপারপাওয়ার ভারত।

অভিষেক ম্যাচে পাঁচ উইকেট নিয়ে ভারত জয়ের নায়ক সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে  মুস্তাফিজ আবার জ্বলে উঠেছেন দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও।  খেলার শুরুর পর নিজের দ্বিতীয় বলে রোহিত শর্মার উইকেট নিয়ে বাংলাদেশকে দারুণ সূচনা এনে দিয়েছিলেন তিনি। এরপর যা করলেন, সোজা ঢুকে পড়লেন ইতিহাসের পাতায়। অভিষেকের পরপর দুই ম্যাচেই ৫ ও ৬ উইকেট নিয়ে এমন কীর্তি দেখালেন যা ওয়ানডে ক্রিকেটের ৪৪ বছরের ইতিহাসে আর দেখেনি কেউ।

সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার তারালি ইউনিয়নের তেঁতুলিয়া গ্রামে নিজ বাড়িতে বসে টিভিতে ছেলের এই সাফল্য দেখে  আনন্দাশ্রু ঝরিয়েছেন বাবা আবুল কাসেম ও মা মাহমুদা খাতুন। পবিত্র রমজানে রোজা রেখে  দুই হাত তুলে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করেছেন, তাঁদের ছেলে যেন এভাবেই জয়ের পর জয়ের নায়ক হয়ে ওঠেন।

আবুল কাসেম জানালেন, মুস্তাফিজের খেলার সময় সারা গ্রাম যেন ভেঙে পড়েছিল তাঁর বাড়িতে। বাড়ির উঠানে বাঁশের সাথে টিভি টাঙ্গিয়ে গ্রামবাসীর সাথে মিলে প্রত্যক্ষ করেছেন ছেলের ক্রিকেট নৈপুণ্য। চোখভরা খুশির অশ্রু নিয়ে গর্বিত ছেলের বাবা বললেন, ‘আমাদের বাড়িই যেন হয়ে উঠেছিল মিরপুর স্টেডিয়াম।’

মুস্তাফিজের সেজো ভাই ব্যবসায়ী মোকলেছুর রহমান পল্টু সহোদরের এই অভাবনীয় সাফল্যে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন ‘ভাইয়ের খেলা দেখতে দেখতে খুশিতে বার বার লাফিয়ে উঠেছি। আর গর্বে বারবার ভিজে গেছে চোখ।’

মুস্তাফিজুরের এই ভাই-ই ১২ বছর বয়স থেকে রোজ ভোরে গ্রাম থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে অনুশীলনে নিয়ে যেতেন ছোট্ট ভাইটিকে। সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামে অনুশীলন শেষে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যেতেন বাড়িতে। পথশ্রমে ক্লান্ত মুস্তাফিজ ভাইকে জড়িয়ে মোটরসাইকেলে ঘুমিয়ে পড়তেন। পড়ে যাওয়ার ভয়ে ভাইয়ের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে রাখতেন।

পল্টু বলেন, ‘বাবা- মা ছাড়াও বড়ভাই মাহফুজার  রহমান মিঠু, ভাবি তানিয়া সুলতানা, মেজো ভাই জাকির হোসেন, ভাবি নাসরিন সুলতানা, আমি ও আমার স্ত্রী রেশমা খাতুন- সবাই মিলে গ্রামের সবার সাথে খেলা দেখেছি। ছিলেন আমাদের ফুফাতো ভাই মিজানুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী, খালাতো ভাই রওনাকুল ইসলাম লাভলু এবং তাঁর স্ত্রী ছেলেমেয়েসহ সবাই।’

গত বৃহস্পতিবার প্রথম ওয়ানডেতে ৫০ রানে পাঁচ উইকেট নিয়ে হৈচৈ ফেলে দেওয়া মুস্তাফিজুর রহমান রোববার দ্বিতীয় ম্যাচে ‘শিকার’ শুরু করতে একদমই সময় নেননি। নিজের এবং ম্যাচেরও দ্বিতীয় বলে রোহিত শর্মাকে ফিরিয়ে তাঁর বোলিং তোপের সূচনা। এরপর সুরেশ রায়না, অক্ষর প্যাটেল ও রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে আউট করে ভারতকে বিপদে ফেলে দিয়েছেন মুস্তাফিজ। এর মধ্যে ধাক্কা-কাণ্ডের ‘প্রতিশোধ’ নিয়ে বিদায় করেছেন ধোনিকেও।

মুস্তাফিজের এই কৃতিত্বে তাঁকে নিয়ে গর্বের শেষ নেই সাতক্ষীরা ক্রীড়াজগতেও।  জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শেখ নিজামউদ্দিন বলেন, ‘সাতক্ষীরার সৌম্য সরকার  বিশ্বকাপে খেলে নিজ জেলাকে মর্যাদার  আসনে তুলে দিয়েছেন। নারী ফুটবলার সাবিনার বল গড়িয়েছে বিদেশের মাটিতেও। আর সাতক্ষীরার মুস্তাফিজ হয়ে গেলেন ভারত বধের নায়ক।’

সহপাঠী বন্ধুরা জানান, স্বভাবে শান্তশিষ্ট মুস্তাফিজ সব সময় ভালো খেলতেন। কিন্তু এত ভালো খেলোয়াড় যে হতে পারেন তা ছিল কল্পনারও বাইরে। বরেয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হাফিজুর রহমান জানান, মুস্তাফিজের লেখাপড়ার দিকে তেমন মন ছিল না। শুধু খেলা আর খেলা। এ নিয়ে অনেক বকাবকি শুনতে হলেও তাঁর এই অতি আগ্রহে এতটুকু বাধা দেয়নি তাঁর পরিবার।

২০১১ সালে বরেয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। ওই সময়ই তাঁর খেলায় মুগ্ধ হয়ে সাতক্ষীরার ক্রিকেট কোচ আলতাফ হোসেন তাঁকে বয়সভিত্তিক খেলায় অংশ নিতে নিয়ে যান।

সাতক্ষীরা জেলার হয়ে অনূর্ধ্ব-১৪ ক্রিকেট দিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে প্রবেশ তাঁর। এরপর বিভাগীয় অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৮ অবশেষে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলে বারবার নিজেকে প্রমাণ করেছেন মুস্তাফিজ। আর সর্বশেষ দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও ভারতকে বিধ্বস্ত করে ছয় উইকেট নিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের এই ছেলেই অভাবনীয় সাফল্য এনে দিলেন তাঁর মাতৃভূমিকে।