স্মৃতির আয়নায় আবাহনীর সোনালি দিনগুলো

Looks like you've blocked notifications!
ছবি : এনটিভি অনলাইন

পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়, ও সেই চোখের দেখা প্রাণের কথা সে কি ভোলা যায়!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এই পঙক্তিগুলো হয়তো বাজছিল সবার কানে। কয়েক ঘণ্টার জন্য সবাই ফিরে গেলেন অতীতে। হৈ হুল্লোড়, গল্প-আড্ডায় ডুবে গেলেন স্মৃতিচারণে। বলছি—আবাহনীর জার্সিতে মাঠ মাতানো তারাদের কথা। আজ শনিবারের দুপুরটায় যারা হারিয়ে গিয়েছিলেন স্মৃতির অতল গহ্বরে। না থেকেও যে স্মৃতিচারণের মধ্যমণি হয়েছিলেন ঢাকা আবাহানী লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল।

উপলক্ষ্যটা ছিল ক্রিকেট লিগে আবাহনী ক্রীড়া চক্রের প্রথম শিরোপা জয়ের ৫০ বছর পূর্তি। ১৯৭৪ সালে একদল তরুণ মিলে যে শিরোপা জয়ের গল্প লেখেন সেই দলের সাতজনের উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে মূল আয়োজন। সেই সঙ্গে আবাহনীর জার্সিতে মাঠ মাতিয়ে যারা পরবর্তী প্রজন্মের উদাহরণ হয়েছিলেন তারাও হাজির হয়েছিলেন। আবাহনীর সব তারকারা এক হতেই শেয়ার করলেন অতীতের নানা স্মৃতি। যার কিছু অংশ নিয়েই এই আয়োজন।

শাহীনশা রিজভি

১৯৭৪ সালে আবাহনী ক্রীড়া চক্রের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মূল কারিগর শাহীনশা রিজভি। যিনি ব্যাট হাতে ৮৯ রানের ইনিংস উপহার দিয়ে জয়ের পথটা তৈরি করে দিয়েছিলেন। আজ শনিবার আবাহনীর তারার মেলায় উপস্থিত হয়েই তিনি ফিরে গেলেন অতীতে। বললেন, ম্যাচটি জিতেই আমরা ছুটে গেলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে। তখন তো ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ বলে কিছু ছিল না। তখন বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের বেস্ট খেলোয়াড় কে? তখন জামাল ভাই আমাকে দেখালেন। সঙ্গে সঙ্গেই পকেটে হাত দিলেন। এরপর আমাকে ১০০ টাকার একটা নোট দিলেন। আমার দুঃখ ওই টাকাটা আমি রাখতে পারিনি। বের হতেই সবাই মিলে আমাকে নিয়ে গেল চাইনিজে। টাকাটা ওইখানেই শেষ। ওই টাকাটা থাকলে ফ্রেম করে আমি রেখে দিতাম।–এই বলেই খানিকটা আবেগি হয়ে উঠলেন আবাহনীর এই তারকা।

ফকরুল আহসান (বাবু)

আমি আবাহনী ক্লাবে ১৯৭৩ সাল থেকে খেলি। শেখ কামাল ভাই আমাকে আনেন এই দলে। আবাহনী ক্লাব ক্রীড়াঙ্গনে সবচেয়ে সেরা ক্লাব। যার মূলে ছিলেন শেখ কামাল। ক্রিকেট-ফুটবলে আজ বাংলাদেশ যতটা দূরে গেছে তার মূল পথটা তৈরি করে গিয়েছেন শেখ কামাল।    

জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা

আমি ক্রিকেটে পরে আসছি। আগে আবাহনীর ফুটবল দলে ছিলাম। ধানমন্ডিতে অনেক ভালো ভালো ক্রিকেটার ছিল তখন। শেখ কামাল আমাকে বলে দিত, এদের সবার সাথে যোগাযোগ করো। শুধু ক্রিকেট নয় ফুটবলেও শেখ কামালের অনেক অবদান। শেখ কামাল খুবই ভালো একজন সংগঠক ছিলেন। তিনি নিজেকে কখনও বড় করে দেখতেন না। তিনি ক্রিকেটও খেলেছেন। একবার একটা ম্যাচে আমাদের তাকে ড্রপ করতে হয়েছিল। কারণ, তার অনুশীলন করা হয়নি। তখন আমি তাকে দুই ঘণ্টার জন্য হলেও অনুশীলন করে খেলতে বলেছিলাম। কিন্তু ডিসিপ্লিনের প্রতি তিনি এতটাই সম্মান দেখিছিলেন যে তাতে রাজি হয়নি। ম্যাচটি ছিল মোহামেডানের বিপক্ষে সেমিফাইনাল। পরে আমরা তাকে ফাইনালে খেলাই এবং শেখ কামালই প্রথম উইকেট নেন। এ ছাড়া আবাহনী দেশের বাইরে থেকে বল এনে দিত দেশের অন্যান্য ক্লাবগুলোকে। কারণ, তখন বল ছিল না। বাইরে থেকে আনতে হতো। আর এই দায়িত্বটা দারুণভাবে করত আবাহনী।

জিয়া

আবাহনী নিয়ে ছোট্ট একটা স্মৃতি শেয়ার করি। আমরা যখন আবাহনীতে খেলি তখন অনেকের ধারণা ছিল আমরা আবাহনীতে খেলে হয়তো অনেক টাকা পাচ্ছি। আসলে আমরা তিনমাসে আড়াইশ টাকা পেতাম। আর খেলার দিন পেতাম ১০ টাকা করে। তখন আসলে আমরা শখ থেকে ক্রিকেট খেলতাম। আজ দেশের ক্রিকেট যে অবস্থানে আছে তাতে শেখ কামালের অনেক অবদান রয়েছে, সেটা ভুলে গেলে চলবে না।

সাজ্জাদুল আলম ববি

আবাহনীর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা চার দশক ধরে। আমি নিজে চোটের সমস্যার কারণে খেলতে পারতাম না। তাই সংগঠনের দিকে চলে গেলাম। সেই থেকে যুক্ত আছি এখনও। আজ যারা চেনে আমাকে সেটা শুধু আবাহনীর জন্যই সম্ভব হয়েছে। আজ এখানে আসতে পেরেছি এই আবাহনীর কারণেই। এই আবাহনীর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আবাহনীর সঙ্গে আমাদের সবার অনেক স্মৃতি। অনেক সময় এক খেলোয়াড়ের থেকে টাকা নিয়ে আমরা আরেকজনকে দিতাম। কারও কোনো অভিযোগ ছিল না।  আমাদের সেই সময়ে খেলোয়াড়রা খেলার পাশাপাশি ক্যারিয়ারও গড়েছে। এই ব্যাপারটা দারুণ ছিল।

মোমেন উদ্দিন আহমেদ (ফোকলা)

আবাহনীর খেলোয়াড়দের কাছে প্রিয় মুখ ‘ফোকলা ভাই’। যিনি আবাহনী জিতলে লাঞ্চ করাতেন। তার কথা শোনার আগেই প্রসঙ্গ টেনে নিয়ে রিজভি বলেন—আমাদের সময় তো ড্রিংক ছিল না। তখন তিনি বালতির মধ্যে পানি নিয়ে লেবু গুলিয়ে লেবুর শরবত খাওয়াতেন। যেদিন অনেক গরম পড়তো তখন তিনি মায়া করে আমাদের গ্লুকোজ খাওয়াতেন। তিনি না থাকলে আমাদের হয়তো অনেকদিন লাঞ্চ হতো না। তিনি আমাদের কাছে সোনার খনি ছিলেন।

জালাল ইউনুস

আবাহনী ক্লাবে আমার পদার্পন হয় ১৯৭৭ সালে। একটা লিগ শুরু হওয়ার আগে আবাহনীর সঙ্গে যুক্ত হই। তখন মোহামেডানের বিপক্ষে খেলেছিলাম। এই আবাহনীতে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত আমি খেলেছি। এরপর চোটের কারণে হয়তো খেলায়াড়ি জীবন নিয়মিত করতে পারিনি। তবে, ১৯৭৭ সাল থেকে আমি এখন পর্যন্ত আবাহনীর সঙ্গেই জড়িয়ে আছি। আবাহনীতে আমার আসার পেছনের বড় অবদান রিজভি ভাই এর। আমি আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দলে খেলতাম। আমি ফার্স্ট বোলার ছিলাম। এরপর শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবে যোগ দেই। সেখান থেকে তিনি আমাকে আবাহনীতে আনেন। এরপর থেকেই চলছে আবাহনীতে পথচলা। একবার আবাহনীর সাথে মোহামেডানের ফাইনাল খেলা ছিল। সেই খেলায় স্লেজিংয়েই আমরা প্রতিপক্ষকে তিক্ত করে ফেলছিলাম। আমরা যে কি খেয়ে খেলতাম তখন সেটা অবিশ্বাস্য ছিল। যে বালতিতে জামাকাপড় ধোঁয়া হতো সেটাই করেই আমাদের শরবত বানিয়ে খেতাম। এমন অনেক স্মৃতি আছে আমারা আবাহনীতে।

নওয়াব

১৯৭৪ সালে যখন আবাহনী দলটা গ্রো করল তখন ক্লাবে যোগ দেই। আমি আর কামাল একই ব্যাচের ছিলাম। একদিন শেখ কামাল আমার বাসায় আসে। তাকে বসিয়ে আম্মাকে বললাম, শেখ কামালকে এক কাপ চা দাও। তখন আম্মা এক কাপ চা দিলেন। এই স্মৃতিটা এখনও জ্বলজ্বল করছে আমার চোখে। কামাল তখন বলেন, ‘আমি এমনে এমনে আসি নাই। তুমি আমার টিমে খেলবা।’ তখন তাকে বললাম, তুমি আসছো আমার জন্য কেন আমি খেলবো না। সেই থেকেই আবাহনীর যাত্রা শুরু। 

গাজী আশরাফ হোসেন লীপু

আমি ১৯৮১ সালে আবাহনীতে যোগ দেই। তবে টানা ১৫ বছর খেলা হয়নি। মাঝে দুই বছর অন্য ক্লাবে খেলি। তবে আবাহনীর লম্বা জার্নিতে আমাদের অনেক স্মৃতি আছে। এখানে থাকা অনেকের খেলা আমি দেখিছি। শুধু একটা কথা বলি। যেটা উইকেটকিপিং নিয়ে। উইকেটকিপিংয়ে জুনিয়র হাসান ভাই ছিলেন দুর্দান্ত। উনার স্টাম্পিংয়ের থেকে বাঁচার উপায় ছিল না। এতটা দুর্দান্ত কিপার ছিলেন তিনি।

নাইমুর রহমান দুর্জয়

আগে তো কোনো দলবদল ছিল না। আমাদের সময় আবাহনী ক্লাবে টাকার কথা বললে বলত, তুমি তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ো তুমি টাকা দিয়ে কি করবে (হাসি)। কেউ মোবাইল ছুড়ে ফেলতো, কেউ দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। তো সবমিলিয়ে এগুলো নিয়ে অনেক নাটক করতো। তখন আমরা এটার (ক্লাবের) নাম দেই বঙ্গবাজার ক্লাব। কারণ অল্প টাকায় তারা ভালো খেলোয়াড় নিয়ে দল গড়তো (হাসি)।

মিনহাজুল আবেদীন নান্নু

তখনকার সময় জিয়া ভাইয়ের কথা আমার মনে আছে। ১৯৭৪ এর সময় আমরা দেখতাম যে, একজন ফাস্ট বোলার অনেক দূর থেকে বল করছে। এছাড়াও বাদশাহ ভাইয়ের কথা আমার মনে পড়ে। তিনি দারুণ একজন অলরাউন্ডার ছিলেন। এত চমৎকার খেলতেন। আমি, ফারুক এখনও যেখানেই যাই, ওনাদের নিয়েই কথাই বলি।

আকরাম খান 

চট্টগ্রাম থেকে এসে আমি রুপালী ব্যাংকের হয়ে খেলছি। তখন রিজভি ভাই আমার ননস্ট্রাইকে ছিল। তখন তো এত মিডিয়া ছিল না, আমি একটা কথা জানতাম দিপু চৌধুরী নামে একজন ফাস্ট বোলার আছে। প্রথমে উনি আমাকে শর্ট বল দিসে আমি চার মারলাম, দ্বিতীয় বল আবারও শর্ট লেন্থে এবার আমি ছয় মারলাম। পরে রিজভি ভাই আমাকে এসে সমানে চুমু দিয়ে বললেন, ‘তুই দিপুকে ছয় মারছিস।’ 

ওমর খালিদ রুমি

আমি ১৯৭৫ সালে আবাহনীতে জয়েন করি। আমি আগে অগ্রণী ব্যাংকে খেলি। সেখান থেকে আমাকে আবাহনীতে আনা হয়।

মামুন আহমেদ

আমি ১৯৭৩ থেকে আবাহনীতে ছিলাম। প্রথমে খেলতাম আজাদ বয়েজ এরপর ওইখান থেকে শেখ কামাল ভাই আমাকে নিয়ে আসেন আবাহনীতে। এরপর এই ক্লাবটির হয়েই ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কাটিয়ে দেই। এই ক্লাবের সঙ্গে আমাদের নানা স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এখানে এসে এক পলকে যেন সব চোখের সামনে ভিড় করছে।

মাহমুদুর রহমান হাসান

কামাল ভাইয়ের মধ্যে অন্যরকম একটা ব্যাপার ছিল, তিনি আমাদের মতো ক্রিকেটারদের একসঙ্গে জড়ো করেছেন। আমাদের খেলার সুযোগ করে দিয়েছেন এবং আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। সেই স্পিরিটটাই আসলে এখনও কাজে দিচ্ছে। তিনি যেভাবে সবাইকে অনুপ্রাণিত করতেন, সেটা আসলেই অসাধারণ।