রিকশায় শুরু লঞ্চে শেষ, কেমন কাটল বিপিএল?

Looks like you've blocked notifications!
ছবি : বিসিবি ও ফরচুন বরিশাল

‘‘এবার হয়েছে সন্ধ্যা, দিনের ব্যস্ততা গেছে চুকে 

নির্বাক মাথাটি পাতি, এলায়ে পড়িব তব বুকে”

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘এবার হলো সন্ধ্যা’ কবিতার দুটি লাইন কি বিপিএলের সঙ্গে যায়? বোধকরি যায়! দিনের ব্যস্ততা শেষে, সাঁঝের আলো ঝলমল রোমাঞ্চ পেরিয়ে ইতি ঘটল বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের দশম আসরের।

বিপিএল মানেই বিতর্ক, সমালোচনা আর নাক সিঁটকানোই ছিল ভবিতব্য। আসর শুরুর আগে-পরে প্রাণ জুড়াতো না। কোথাও যেন অপূর্ণতার হাহাকার, ব্যর্থতার বিষোদগার চলত। দশম আসরে এসে সেসব একেবারে পার করেছে তেমনটি নয়, তবে সমালোচনা আর বিতর্কের জায়গায় ফুটেছে সৌন্দর্যের ফুল। বসন্তের হিমেল হাওয়ায় শীতের শুষ্কতা কেটে রঙিন হয়েছে দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট।

শুরুতেই চমক দেখিয়েছে বিপিএল কর্তৃপক্ষ। রিকশা পেইন্টিংকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছিল ইউনেস্কো। লোগো আর পুরো আসরের গ্রাফিক্স কার্ডে ফুটে ওঠে তা। রিকশা হয়ে লঞ্চে করে ট্রফি পাড়ি জমিয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের শহর বরিশালে, মাঝে ঘটেছে অনেক কিছু। সেসব নিয়েই এই আয়োজন।

নতুন রাজার দেখা

বিপিএলের দশম আসরের শিরোপা উঠেছে ফরচুন বরিশালের হাতে। আসরজুড়ে চমৎকার খেলা বরিশাল ফাইনালে পাত্তাই দেয়নি চারবারের চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সকে। তামিম ইকবালের নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো শিরোপা জয়ের স্বাদ পায় দলটি। অথচ তামিম খোদ বলেছিলেন, একটা সময় তারা নিজেরাই বিশ্বাস করতে পারেননি প্লে-অফ খেলবেন। দলগত পারফরম্যান্সের শক্তিতে সব বাধা পেরিয়ে শিরোপা গেছে পদ্মার ওপারে। 

উইকেটে রানের জোয়ার

মিরপুরের মন্থর পিচ নিয়ে সারাবছরই সমালোচনা চলে। কেউ কেউ তো ধানক্ষেতের সঙ্গে প্রায়ই তুলনা দিয়ে বসতেন। দর্শকদের অভিযোগ আমলে নিয়ে আসর শুরুর আগেই টুর্নামেন্ট কর্তৃপক্ষ বলেছিল, এবারের বিপিএল হবে রানের আসর। কথা রেখেছেন তারা। সিলেট, চট্টগ্রামের মতো ঢাকাতেও মোটামুটি রানের ফোয়ারা ছুটেছে। টি-টোয়েন্টি মানেই ধুন্ধুমার ব্যাটিংয়ের প্রদর্শনী। ব্যাকরণসিদ্ধ নয়, ধারাপাতের বাইরে গিয়ে শট দেখতে চাওয়ার আশা পূর্ণ হয়েছে দর্শকের। মিলেছে চোখের শান্তি, অন্তরের তৃপ্তি।

ব্যাটে-বলে দেশিদের দাপট

বাংলাদেশি ক্রিকেট ভক্তদের আক্ষেপ, আইপিএল-পিএসএল থেকে ভারত-পাকিস্তানের আগামীর তারকা বের হয়। কিন্তু, আমাদের বিপিএল মাতিয়ে যায় বিদেশিরা। দেশের ক্রিকেটাররা পেছনে পড়ে থাকেন। এবার সেই আক্ষেপও মিটেছে কড়ায়-গণ্ডায়। সেরা পাঁচ ব্যাটারের সবাই বাংলাদেশি। আছেন তাওহিদ হৃদয়, তানজিদ হাসান তামিমের মতো আগামীর তারকারা। বোলিংয়ে সেরা পাঁচে চারজনই দেশি তারকা। শরিফুল ইসলাম, তাসকিন আহমেদ, সাইফউদ্দিনরাই তো বল হাতে আগামীর বাংলাদেশ। এদিক থেকে এবারের বিপিএলকে দশে দশ অনায়াসে দেওয়া যায়।

মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর শাপমোচন

বাংলাদেশের ক্রিকেট মানেই পঞ্চপাণ্ডব—ব্যাপারটা দীর্ঘদিন ধরে এমন ছিল। দেশের ক্রিকেটকে অনেকদূর নিয়ে যাওয়ার পেছনে তাদের ভূমিকা অসামান্য। পাঁচজনের ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত পারফরম্যান্সের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আজকের বাংলাদেশ। ব্যক্তিগত অর্জনে সমৃদ্ধ প্রত্যেকের ক্যারিয়ার। পঞ্চপাণ্ডবের তিনজন— মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা, সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালের ঝুলিতে বিপিএলের শিরোপা থাকলেও এতদিন বঞ্চিত ছিলেন মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ। সেই শাপমোচন হয়েছে এবার। দশম আসরের শিরোপা উঠেছে ফরচুন বরিশালের হাতে। যে দলের অন্যতম দুই কাণ্ডারি মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ। ১০ বছর বিপিএল খেলে এবারই প্রথম ট্রফি ছুঁয়ে দেখলেন দুজন। তাদের হাতে বেড়েছে ট্রফির শোভাও।

তামিমের রাজসিক প্রত্যাবর্তন

আলোচনা-সমালোচনা-বিতর্ক; বিপিএল শুরুর আগে তামিম ইকবালের অবস্থা ছিল এমনই। দেশসেরা ওপেনার বিপিএল দিয়ে দীর্ঘ সময় পর ফিরেছেন মাঠের ক্রিকেটে। ফরচুন বরিশালের অধিনায়ক ফিরেই প্রমাণ করলেন কেন তিনি সেরা! তার হাত ধরেই বরিশাল পেয়েছে প্রথম শিরোপা জয়ের স্বাদ। দলকে শিরোপা জেতানোর পাশাপাশি চলতি আসরে সবচেয়ে বেশি রান এসেছে তামিমের ব্যাট থেকেই। ১৫ ম্যাচে ১২৭.১৩ স্ট্রাইকরেটে ৪৯২ রান করেছেন তিনি। ফিফটি ছাড়ানো ইনিংস আছে তিনটি। ব্যাট হাতে ৩৭.৮৪ গড়ই প্রমাণ দেয়, কতটা ধারাবাহিক ছিলেন তামিম। হয়েছেন টুর্নামেন্টসেরা।

উন্নত প্রযুক্তি, আম্পায়ারিং ও ধারাভাষ্য

নয়টি আসর শেষ করলেও সেভাবে প্রযুক্তিগত ছোঁয়া পায়নি বিপিএল। ঘরোয়া ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসর হলেও নিম্নমানের সম্প্রচার স্বত্ব, ডিআরএস না থাকা, ক্যামেরার কোয়ালিটি, সাদামাটা গ্রাফিক্স— বিপিএলে বরাবরই হতাশ করেছে প্রযুক্তির ব্যবহার। তবে, দশম আসরে এসে রাখা হয়েছে সম্ভাব্য সেরা সব প্রযুক্তি। শুরু থেকেই ছিল ডিআরএস বা ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম। রিভিউ থাকা মানে হক আই রাখাটা আবশ্যক। রাখা হয়েছে সেটিও। প্রায় ৩৬টি অত্যাধুনিক ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৮টি সরাসরি পরিচালনা করেছেন অপারেটররা। বাকিগুলো স্বয়ংক্রিয়। রাখা হয়েছিল ড্রোন ক্যামেরাও। চারপাশ থেকে কাভারেজ দেখে বিপিএলকে এবার অন্তত পানসে মনে হয়নি।

পাশাপাশি আম্পায়ারিং ও কমেন্ট্রিও হয়েছে অন্য যে কোনো আসরের তুলনায় অসাধারণ। আম্পায়ারিংয়ে ভুল ছিল কম, কমেন্ট্রিতে ছিল উন্মাদনা বাড়িয়ে দেওয়ার খোরাক।

মাঠের আলোচনাই মুখ্য

নানা কারণেই অন্যান্য আসরগুলোতে মাঠের বাইরের ইস্যু নিয়ে আলোচনা হতো বেশি। এবার শুরু থেকেই বিপিএল কর্তৃপক্ষ ছিল যথেষ্ট সচেতন। সামাল দিয়েছে দারুণভাবে। উন্নত প্রযুক্তি, মাঠের খেলায় তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা, স্বচ্ছতা ও সৌন্দর্যের মিশেলে বাইরের আলোচনা বলতে গেলে হয়নি। শেষের দিকে এসে জাতীয় দলের প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের বিতর্কিত এক মন্তব্য ছাড়া সব আলোচনাই হয়েছে খেলাকেন্দ্রিক। এ ধরণের টুর্নামেন্টের জন্য যা ভীষণ ইতিবাচক।

দর্শকের বিপুল সাড়া

অন্যান্য আসরের চাইতে এবার দর্শক সাড়াও ছিল দেখার মতো। ৪৬ ম্যাচের বেশিরভাগ ম্যাচগুলোতেই স্টেডিয়াম ছিল দর্শকে ভরপুর। খেলার মান বাড়লে দর্শকের আকর্ষণ বাড়ে, এটি আরেকবার প্রমাণিত হলো। বিপিএলের প্রথম আসরের পর সম্ভবত দশম আসরই সবচেয়ে বেশি দর্শক মাঠে বসে দেখেছে। বিশেষত ঢাকার বাইরে সিলেট ও চট্টগ্রামে প্রায় সব ম্যাচই ছিল হাউজফুল। টিভি ও অনলাইনেও বৈধভাবে খেলা দেখায় দর্শকের আগ্রহ ছিল তুঙ্গে।

সবমিলিয়ে বিপিএলের দশম আসরকে সবদিক থেকে সফল বলা যেতেই পারে। অন্তত বাকি নয় আসর থেকে বেশ এগিয়ে। দশম আসরকে দশে দশ না দেওয়া গেলেও লেটার মার্কে পাস না দিয়ে উপায় নেই। উন্নতির আরও জায়গা আছে বলে এবং চাওয়ার সঙ্গে পাওয়ার অনেকটা মেলবন্ধন হওয়ায়, আগামীতে বিপিএল নিয়ে ভক্তরা ভালো কিছুর প্রত্যাশা রাখতেই পারে।