ভিন্ন এক তামিমের জন্মদিন!
তামিম ইকবাল খান কখনও স্বভাবজাত, কখনও স্বভাববিরুদ্ধ। ডাউন দ্য উইকেটের প্রতি পদক্ষেপে সীমানা ছাড়া করেছেন উৎকণ্ঠাকে, আলিঙ্গন করেছেন ভালোবাসাকে। সেসব এতদিন ফুল হয়ে ঝরেছিল ভক্তদের বাগানে, এখন বিঁধছে কাটা হয়ে। তামিম একটা সময় আলোচনায় ছিলেন খেলার জন্য। দেশসেরা ওপেনার তার ক্রিকেটীয় ছন্দ আর দ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনায় থাকবেন, এটিই স্বাভাবিক।
তামিম এখন যতটা না খেলা নিয়ে আলোচনায়, তার চেয়ে বেশি আলোচনায় খেলার বাইরের বিষয় নিয়ে। স্পষ্ট করে দেওয়া ভালো, পুরো আলোচনাই ক্রিকেট বহির্ভূত। সমালোচিত হচ্ছেন বারবার নিজ দোষেই। তবে, কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে, তামিমের জন্মদিন মানেই যেন বাংলার ক্রিকেটে গল্পের আনাগোনা। এবারের জন্মদিনেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। ২০ মার্চ, তামিমের আগমন ঘটে পৃথিবীতে। ১৯ মার্চ ২০২৪ এ, আলোচনা বেফাঁস ফোনালাপ নিয়ে। পরদিন, মানে আজ তিনি জানাবেন ফোনালাপের আদ্যোপান্ত।
গত কয়েক বছরে তামিমের প্রতিটা জন্মদিনের ঠিক আগে আগে টিম বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে একেকটি গল্প। কোনোটি হাহাকারের, কোনোটি উল্লাসে ফেটে পড়ার, কোনোটি রেকর্ড গড়ার।
২০১৫ সালের ১৮ মার্চ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে বিতর্কিত পরাজয়ে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় নীল হওয়া। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ আসে দুই সতীর্থ তাসকিন আহমেদ-আরাফাত সানির নিষেধাজ্ঞা। বন্ধুর পথ পেরুলে শেষটায় আলোর রেখা দেখা দেবেই। ২০১৭ সালের ১৯ মার্চ বাংলাদেশের ক্রিকেট আকাশে উদিত হয় নতুন সূর্য। শততম টেস্ট ম্যাচে বাংলাদেশ পায় ঐতিহাসিক জয়। লঙ্কাবধের সে ম্যাচ তামিম কেবল অংশ নেওয়া এগারো জনের একজন হয়ে থাকেননি। প্রথম ইনিংসে ৪৯, দ্বিতীয় ইনিংসে ৮২ রান করে তৈরি করেছেন শক্ত ভীত। যাতে দাঁড়িয়ে বাঘেরা উড়িয়েছে বিজয় কেতন।
২০১৯ সালের ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ থেকে ফিরেছেন মৃত্যুকে হাতছোঁয়া দূরত্বে রেখে। আর এবারের জন্মদিনে ছুঁয়েছেন প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৫ হাজার রানের মাইলফলক। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে এই রেকর্ড স্পর্শ করেছেন তিনি। বাংলাদেশ গড়েছে একদিনের ক্রিকেটে নিজেদের সর্বোচ্চ রানের ইনিংস।
১৯৮৯ সালের ২০ মার্চ ইকবাল খান ও নুসরাত খান দম্পতির ঘরে চট্টগ্রামে জন্ম নেন এই ব্যাটার। জন্মের পর একটা সময় বুঝতে শিখেছেন, চাচা আকরাম খান আর বড় ভাই নাফিস ইকবালের প্রিয় সবুজ প্রান্তর তাঁকে ডাকছে। অগ্রজের হাতে হাত রেখে তাই তাঁর মাঠ চেনা, চাচার আশীর্বাদে সাহসী হওয়া।
একটা সময় বাংলাদেশের ক্রিকেটে স্ট্রাইক রেট শব্দটা শুনতে বড্ড বিলাসী ঠেকতো। মাটি কামড়ে কটা রান করতে পারলে তা নিয়ে হইচই বাধার ওই সোনালি শৈশবে তামিম ইকবাল কী ভাবতেন, তা তখন কেবল তিনিই জানতেন। তবে, বড় হয়ে সবাইকে তা জানানোর সুযোগ করে দেন এই ব্যাটার।
লঙ্কান ব্যাটসম্যান সনাৎ জয়াসুরিয়াকে আদর্শ মানেন তামিম। বাঁহাতি ওই তারকা ওপেনার ছিলেন ধুন্ধুমার। তামিম কেনো তার ব্যতিক্রম হবেন? ক্যারিয়ারের সকালে নরম সূর্যের আঁচে তাই পেয়েছিলেন ‘দুম দুম’ তকমা। সকালের সূর্য দিনের পূর্বাভাস দেয় না বলে দুম দুম তামিম খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারছিলেন না।
লালসবুজ প্রথমবার গায়ে চাপান ২০০৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। মাত্র দুই ম্যাচ খেলেই ডাক পড়ে নবম বিশ্বকাপের আসরে। এর আগের বছর শ্রীলঙ্কায় অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলে এসেছেন। মাত্র এক বছর আগের যুবক পরের বছর উত্তপ্ত কড়াইয়ে। পুড়ে যাবার ভয় ছিল। পুড়েছেন। কিন্তু ছাই হয়ে উড়ে যাননি। লোহা পুড়ে সোনা হয়, তিনি পুড়ে হয়েছেন পোক্ত। বিশ্ব আসরে ভারতবধ মহাকাব্যের অন্যতম প্রধান সৈনিক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছেন, জানান দিয়েছেন অস্তিত্ব।
ভারতীয় পেসার জহির খান তামিমকে ভুলবেন না কখনও। কচি এক বালকের ডরহীন চাহনি, ঔদ্ধত্যপনায় তুলোধুনা হওয়াটা এক অভিজ্ঞজনের কাছে মোটেই মধুর নয়। সেসব নিয়ে ভাবতে তামিমের বয়েই গেছে। ৫৩ বলে ৫১ রানের সেই ইনিংসের রথে চেপে বাংলাদেশের ক্রিকেট আকাশে যে ভ্রমণ শুরু করেছেন, তা আজও অব্যাহত। মাঝে মাঝে রানওয়েতে যাত্রা বিরতি নিয়েছেন। প্রতি স্টপেজেই রাখছেন প্রতিভার স্বাক্ষর।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় দলের হয়ে খেলা শুরু করা তামিম ইকবালের টেস্ট অভিষেক হয় ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে, নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে। অভিষেকেই অনন্য। দুই ইনিংসে যথাক্রমে ৫৩ ও ৮৪ রান করে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটান। তারপর সময় কেটেছে। এরপর ক্যালেন্ডারে ২০১১ আসে। ইংল্যান্ডের লর্ডসে করেন প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে টেস্ট শতক। নাম ওঠান অনার্স বোর্ডে নাম। এরপর ম্যানচেস্টার। সেখানেও শতক। ব্যাক টু সেঞ্চুরি, এখানেও প্রথম তিনি। কাজের স্বীকৃতি পেতে দেরি হয়নি। উইজডেন সাময়িকীর বর্ষসেরা ক্রিকেটারের খেতাব মিলে যায়।
২০১২ সালে এশিয়া কাপ শুরুর আগে তামিমকে ঘিরে বিতর্ক দানা বাঁধে–দলে নেই তিনি। সেই সময়ের বোর্ডপ্রধান চাচা আকরাম খান পদত্যাগ করলেন। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে দলে ফিরলেন তামিম। চাচার জোরে খেলেন কথাটা বাতাসে আরও ভারী হতে থাকে। কিন্তু, ভিন্ন ধাতুতে গড়া তামিম জবাব দিলেন ব্যাটে। ততদিনে দুম দুম থেকে বেরিয়ে এসেছেন অনেকটা। নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছেন। সেই সিরিজে টানা চার ম্যাচে চার ফিফটি, চার আঙুল দেখিয়ে সেলিব্রেশনে দিলেন উপেক্ষার সমুচিত জবাব।
তামিমের রেকর্ডের ভাণ্ডারটা বেশ সমৃদ্ধ। তিন ফরম্যাটেই দেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক, সর্বোচ্চ সেঞ্চুরি, একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে তিন ফরম্যাটেই শতক, টি-টোয়েন্টিতে প্রথম সেঞ্চুরিয়ান, মমিনুল হকের আগে টাইগারদের মধ্যে টেস্টে দ্রুততম হাজার রান।
অথচ, এত কিছুর পরও তিনি এখন তিক্ত অতীত। তবু, তামিম ইকবাল বাংলার ক্রিকেটে একজনই। জন্মদিনের শুভেচ্ছা।