স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল : জেদ আর ভালোবাসার আলপনা এঁকেছিলেন যারা
রক্তের দাগ মোছেনি, বারুদ গন্ধে মাতাল শহর। শহরতলির বুকে ভয়ের চোরাস্রোত। কেউ চির ঘুমে, কারও ঘুম উড়ে গেছে। কেউ নেমেছেন সম্মুখ সমরে, বাকিরা প্রস্তুতি নিয়েছেন দেশের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেবেন বলে।
বুদ্ধদেব বসু তার মুক্তিযুদ্ধের কবিতায় লিখেছিলেন—
‘আবিষ্কার করো সেই জগৎ, যার কোথাও কোনো সীমান্ত নেই
আলিঙ্গন করো সেই জগৎকে, পরষ্পরের চেতনার মধ্যে নিবিড়
তোমাদের হৃদয় আজ ছড়িয়ে পড়ল
ঝাউবনে মর্মর তুলে, সমুদ্রের নিয়তিহীন শব্দে
নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে, দিগন্তের সংকেত রেখায়!’
সেই হৃদয়ের ডাকে সাড়া দিয়ে রচিত হয়েছিল ইতিহাসের অমর আখ্যান—‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।’
মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি...
উত্তপ্ত একাত্তরে দেশ অস্থির। চারিদিকে হাহাকার, বেঁচে থাকা দায়। সবাই যার যার জায়গা থেকে টিকে থাকার লড়াইয়ে অবদান রাখছে। তখন যেন দেবদূত হয়ে এলো একদল তরুণ। ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’—যুদ্ধের হিংস্রতার মাঝে বাংলার ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী এক সংগঠনের বেড়ে ওঠা।
একটি ফুটবল দলকে কি সংগঠন বলা চলে? বিতর্ক থাকতে পারে। সুসংগঠিত ও সাজানো বাগানের মতো সুবাস ছড়িয়ে প্রেরণার বাতিঘর হওয়া দলটিকে সংগঠন বলা যেতেই পারে। সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিয়েও যে অবদান রাখা সম্ভব, তারা সেটি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ নামক ফুলকে বাঁচাতে পায়ের জাদুতে বিমোহিত করেছেন গোটা জাতিকে, পরাধীনতার বেড়াজাল ভাঙতে আশ্রয় নিয়েছিলেন সবুজ গালিচার।
২৫ জুলাই, ১৯৭১। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে নদীয়া জেলা ক্রীড়া সমিতি দল খেলতে নামে প্রীতি ম্যাচে। বিপক্ষে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। অথচ দেশ তখনও পরাধীন। তাতে কী এসে যায়? মন-মগজে তো বাংলাদেশ স্বাধীন। জাকারিয়া পিন্টুর নেতৃত্বে দলটি সেদিন এমন কিছু কাণ্ড করে, যতদিন বাংলাদেশ আছে তা ইতিহাস হয়ে থাকবে। বিশ্বের নিপীড়িত বহু জাতি অনুপ্রাণিত হবে সাহসী সেই উপাখ্যান পড়ে।
মাঠে নামার আগে স্বাধীন বাংলা দলকে জাতীয় পতাকা ওড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়নি জাতীয় সংগীত গাওয়ার অনুমতি। যে পতাকার জন্য লড়াই, যে গানের জন্য সংগ্রাম, সেসব ছাড়া নামবে কেন স্বাধীন বাংলার কাণ্ডারিরা? শেষ অবধি পুরো মাঠ প্রদক্ষিণ করেছিল লাল সবুজের পতাকা, মাঠে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল জাতীয় সংগীত। সেবারই প্রথমবার আনুষ্ঠানিকভাবে ওড়ানো হয় বাংলাদেশের পতাকা, গাওয়া হয় ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ হাজার হাজার বাঙালির চোখের কোণে চিকচিক করছিল অশ্রুর মুক্তো দানা।
এবার একটু পেছন ফিরি...
তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গড়ে তোলা হয়। এর পেছনে যিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, তিনি সাইদুর রহমান প্যাটেল। একাধারে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের উদ্যোক্তা, সংগঠক ও খেলোয়াড়। নিজের ভাবনার আকাশে উঁকি দেওয়া ইচ্ছের কথা প্যাটেল জানান জাতীয় নেতা কামরুজ্জামানের কাছে। সব শুনে কামরুজ্জামান ও ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্য শামসুল হক তাকে সোজা নিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের কাছে। তিনি বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির অনুমোদন দিয়ে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠনের নির্দেশনা দেন। সেদিন ১৩ জুন। প্যাটেলের হাতে প্রধানমন্ত্রী তুলে দিয়েছিলেন ১৪ হাজার ভারতীয় রুপি। ব্যস, স্বপ্নপূরণের সাহসটা বেড়ে গিয়েছিল প্যাটেলের।
বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদনের পর ইন্ডিয়ান ফুটবল ফেডারেশন ও কলকাতার অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল। অনুশীলনের জন্য দরকার ছিল মাঠ। খেলোয়াড়দের থাকার জন্য আবাসন ব্যবস্থা। অনুমোদন, পার্ক সার্কাসে মাঠ পাওয়া, খেলোয়াড়দের থাকার জন্য কুমিল্লার জনৈক আকবরের একটি ফ্ল্যাট বিনা ভাড়ায় নিশ্চিত হয়।
অনুমোদন তো হলো, পালা ফুটবলার খোঁজার...
অনুমোদন, থাকার জায়গা নিশ্চিতের পর ফুটবলারের খোঁজে নামেন প্যাটেল। ভাবছেন, এত আয়োজন হয়ে গেল ফুটবলার ছাড়াই? রণক্ষেত্রে নামার আগে সবকিছু প্রস্তুত রাখতে হয় যে! স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়, বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির ব্যানারে একটি ফুটবল দল হবে। বাংলাদেশের সকল ফুটবলার যেন যোগ দেয়।
আহ্বান যখন দেশের জন্য, ফুটবলাররা ঘরে বসে থাকেন কীভাবে? শাহজাহান আলম, মনসুর আলী লালু, শেখ আশরাফ আলী, আলী ইমাম, প্রতাপ শংকর হাজরা, খন্দকার মো. নূরুন্নবী, আব্দুল হাকিম—কয়েকজনকে খুঁজে বের করেন প্যাটেল। বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের কার্গোতে করে কমিটির সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমান, প্রতাপ শংকর ও অন্য একজন সদস্য আগরতলা গিয়েছিলেন ফুটবলার আনতে। কয়েকদিন পর দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন জাকারিয়া পিন্টু। এক দুই করে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে খেলোয়াড় সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৪ জনে। মাজহারুল ইসলাম তান্নাকে ম্যানেজার ও ননী বসাককে কোচ করে শুরু হয় লড়াইয়ের প্রস্তুতি।
মাঠে নামার মাহেন্দ্রক্ষণ...
তারপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। যে ম্যাচে ফলাফল কোনো বিষয়ই নয়। তা নিয়ে না আগে, না পরে কারও মাথাব্যথাই ছিল না। বল পায়ে বিদ্রোহের ফুল ফোটানোর নেশা ছাপিয়ে গেছে সমস্ত মোহকে। কৃষ্ণনগর স্টেডিয়াম সাজে লাল-সবুজের সাহসিকতায়। শাহজাহান ও এনায়েতুর রহমানের গোলে নদীয়া জেলা ক্রীড়া সমিতির সঙ্গে ম্যাচটি ড্র হয় ২-২ গোলে। ওই যে ফলে কী এসে যায়! বাংলাদেশ তো সেদিন আরও বড় কিছু পেয়েছিল। লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানোর বুনো আনন্দ, গলা ছেড়ে সোনার বাংলা গাইবার অশ্রুভেজা সুখ কী আর ৯০ মিনিটের ব্যাপ্তিকালে বোঝা সম্ভব?
আরও ম্যাচ খেলেছে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। কোনোটা জিতেছে, কোনোটা হেরেছে। কোথাও বলা আছে মোট ১৩টি ম্যাচে অংশগ্রহণ করেছেন পিন্টু, সালাউদ্দিনরা। কোথাও বলা হয় ম্যাচের সংখ্যা ১৬। ম্যাচ সংখ্যা যা-ই হোক, সে সময় প্রায় ১৬ লাখ ভারতীয় রুপি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংগ্রহ করে দেয় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। উজ্জীবিত করে পায়ের জাদুতে। প্রথম ম্যাচের আগে জাকারিয়া পিন্টু ও প্রতাপ শংকরের নেতৃত্বে বাংলাদেশের পতাকা হাতে মাঠ প্রদক্ষিণের সেই ছবি হয়ে আছে বাংলাদেশের ক্রীড়া ও যুদ্ধের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি। একটি ফুলকে বাঁচাতে ৩৪ মালির এমন লড়াই আর কোথাও কেউ দেখেনি!
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ৩৪ ফুটবলার
জাকারিয়া পিন্টু (অধিনায়ক), প্রতাপ শংকর হাজরা (সহ-অধিনায়ক), আলী ইমাম, কায়কোবাদ, অমলেশ সেন, আইনুল হক, শেখ আশরাফ আলী, বিমল কর, শাহজাহান আলম, মনসুর আলী লালু, কাজী সালাহউদ্দিন, এনায়েতুর রহমান খান, নওশেরুজ্জামান, সুভাস চন্দ্র সাহা, ফজলে সাদাইন খোকন, আব্দুল হাকিম, তসলিম উদ্দিন শেখ, আমিনুল ইসলাম সুরুজ, আব্দুল মমিন জোয়ার্দার, মনিরুজ্জামান পেয়ারা, আব্দুস সাত্তার, গাণ গোবিন্দ কুন্ডু, মজিবুর রহমান, মেজর জেনারেল খন্দকার মো. নুরুন্নবী, লুৎফর রহমান, অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জি, সঞ্জিত কুমার দে, মাহমুদুর রশিদ, সাইদুর রহমান প্যাটেল, দেওয়ান সিরাজ উদ্দিন, নিহার কান্তি দাস, মোজাম্মেল হক, বীরেন দাস বীরু, আব্দুল খালেক।
প্রশিক্ষক : ননী বসাক।
ম্যানেজার : তানভীর মাজহারুল ইসলাম তান্না।