চলুন দেখে আসি ঐতিহ্যবাহী ভাসমান হাট

Looks like you've blocked notifications!
বানারীপাড়ার ধান-চালের ভাসমান হাট। ছবি: হৃদয় শাহা

ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই বানারীপাড়া দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত। এমন পরিচয়ের পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে এখানকার ধান-চালের ভাসমান হাট । ওয়ার্ল্ড হেরিটেজেও বানারীপাড়ার এ ধান-চালের ভাসমান হাটটি স্থান পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ বাজারের পরিধি কিছুটা সংকুচিত হয়েছে। তবুও টিকে আছে ঐতিহ্যবাহী এই হাট। বানারীপাড়া ধান-চালের ভাসমান হাটটি নিজ চোখে দেখতে প্রতিনিয়ত ছুটে যাচ্ছেন পর্যটকরা। একবার ঘুরে আসতে পারেন আপনিও।

বাজারের আদিকথা

বরিশালকে যে বালাম চালের জন্য বিখ্যাত বলা হয়, সেই চাল বানারীপাড়ায়ই প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়। প্রায় দুশ-বছর পূর্বে বানারীপাড়ায় ধানচালের ব্যবসার গোড়াপত্তন হয়। কালক্রমেই এর বিস্তৃতি ঘটে। বানারীপাড়ায় প্রক্রিয়াজাত বালাম চালের চাহিদা ও সুনামের জন্য ঢাকা, রংপুর, দিনাজপুর, খুলনা, ফরিদপুর, পটুয়াখালী, সন্দ্বীপসহ বিভিন্ন এলাকার শতশত ফরিয়া এখানে এসে চাল ক্রয়-বিক্রয় করে নিয়ে যেতেন। এছাড়া পটুয়াখালী, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, ভোলাসহ প্রভৃতি স্থানের ব্যবসায়ীরা তাদের উৎপন্ন ধান বিক্রি করতে বানারীপাড়ায় আসতেন। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধানচালের ব্যবসার ওপর বানারীপাড়ার অন্যান্য ব্যবসা নির্ভরশীল ছিল। লোকমুখে শোনা যায়, সন্ধ্যা নদীতে এক সময় ভাসমান ধান-চালের হাটে এত বেশি নৌকা আসত যে, নদীর এপার থেকে ওপারে এক নৌকা থেকে অন্য নৌকা, এ রকম করেই নদী পার  হওয়া যেত। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ধান-চাল বেচা কেনায় ব্যস্ত থাকতেন ব্যবসায়ীরা।

তবে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, নৌকায় চলাচলের অভ্যস্ততা কমে যাওয়া, বালাম চালের চাহিদা কমা, অত্যধিক অটো রাইসমিল গড়ে ওঠা এবং আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে চাল উৎপাদন হওয়াসহ নানা কারণে এ বাজারের সেই প্রাচীন অস্তিত্বে ভাটা পড়েছে। তবুও বিলুপ্ত হয়নি বাজারটি।

যা দেখবেন

বানারীপাড়ায় ধানচালের হাট বসে শনিবার ও মঙ্গলবার। তবে রোববার ও বুধবারেও ধান চাল বেচাকেনা হয়। সন্ধ্যা নদীতে নৌকায় ভাসমান হাটে আসে শত শত ক্রেতা-বিক্রেতা। একসময় বানারীপাড়া বন্দর বাজার, পশ্চিমপাড় থেকে শুরু করে রায়েরহাট পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার জুড়ে সন্ধ্যা নদী ও এর শাখা নদী-খালে ভাসমান অবস্থায় হাজার হাজার নৌকায় ধান-চালের হাট বসত। বর্তমানে বানারীপাড়ার লঞ্চঘাট সংলগ্ন চালের হাট এবং নদীর পশ্চিমপাড় দান্ডহাটে ভাসমান ধানের হাটটি বসে।

এখানে দেখা যাবে, ধান কেনা-বেচার মহাউৎসব। বেপারী, মাঝি-মাল্লা, কয়াল (ওজনকারী), শ্রমিক, চাল ঝাড়ার জন্য নারী শ্রমিকের মতো অনেক পেশার মানুষের কর্মযজ্ঞ চোখ আটকাবে। এখানে আরেকটি দ্রব্য বেশ নজর কাড়ে, যার নাম ডোলা। ১০ থেকে ২৫ মণ চালবোঝাই করার মতো বাঁশের তৈরি পাত্রকে বলা হয় ডোলা। কুটিয়ালরা নৌকার মধ্যে এসব ডোলা বসিয়ে চাল বোঝাই করে হাটে নিয়ে আসে। খুব সকাল থেকে ধান-চালের পসরা বসে। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত জমজমাট থাকে বাজার। বেলা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে মানুষ। দূরের পাইকাররা দূরযাত্রা শুরু করে দুপুরের পরপর।

ধান নিয়ে নৌকার সারি, ইঞ্জিনচালিত ট্রলার আর কার্গোবাহী লঞ্চে চাল বোঝাইয়ের দৃশ্য দেখলে মনে হবে, এ যেন কোনো শিল্পীর হাতে আকা একটি জীবন্ত ক্যানভাস।

যাতায়াত

ঢাকার থেকে লঞ্চযোগে বরিশাল যেতে পারেন। খুব ভোর নাগাদ বরিশালের ঘটে লঞ্চ পৌঁছায়। লঞ্চঘাট বা নথুল্লাবাদ বাসস্টান্ড থেকে বানারীপাড়া যাওয়ার সিএনজি আটোরিকশা আছে। বরিশাল পর্যন্ত আপনার খরচ হবে যাত্রাভেদে ২০০ থেকে ৬০০০ টাকা পর্যন্ত। লঞ্চের ডেকে ২০০ টাকা, সিঙ্গেল কেবিন ১২০০-১৫০০ টাকা, ডাবল কেবিন ২০০০-২৬০০ টাকা, ভিআইপি কেবিন ৫০০০-৬০০০ টাকা। বাসেও যাওয়া যাবে বরিশাল অবধি। আর বরিশাল থেকে বানারীপাড়া যাওয়ার জনপ্রতি খরচ ৫০-৮০ টাকা।

থাকা- খাওয়া

সারাদিন কাটিয়ে রাতেই ফিরে আসা যাবে। আর থাকতে চাইলে, বানারীপাড়ায় মোটামুটি মানের হোটেল, ডাক বাংলো পাবেন। স্বরূপকাঠিতেও থাকা যাবে। ভিআইপিভাবে থাকতে চাইলে ফিরতে হবে বরিশাল সদরে। আর খাবারের ব্যবস্থা স্থানীয় রেস্তোরাঁয়।

মনে রাখুন

একই ভ্রমণে দেখতে পারেন স্বরূপকাঠির রূপ, গুঠিয়া মসজিদ, মাধব রাজার দূর্গাসাগর, শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের বাড়ি, শেরেবাংলা স্মৃতি জাদুঘর, শেরেবাংলা কলেজসহ আরো কিছু ভ্রমণের জায়গা। অবশ্যই শনিবার ও মঙ্গলবারকে টার্গেট করে যাবেন। সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে বাজার দেখার স্বাদ মিলবে না।