বাঙালি রাষ্ট্রপতির আতিথেয়তায় ভারত দর্শন

প্রতিবছরই ভারত সরকারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের ১০০ তরুণ-তরুণী সে দেশে যান। এই সুযোগে দেখা হয়ে যায় ভারতের ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনাগুলো। ঢাকা থেকে আমাদের দিল্লি যাত্রা হয় ৪ অক্টোবর। আর শত তারুণ্যের মধ্যে থাকে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তরুণ সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার আরো কয়েকজন। অনুপাতে আমরা সমানে সমান। ৫০ নারী, ৫০ পুরুষ।
ভারত সরকার এ সুযোগ দিয়ে আসছে ২০১২ সাল থেকে।
দিল্লি পৌঁছেই ইন্ডিয়া গেট আমাদের বিস্মিত করে। দর্শনীয় দুয়ার দর্শন দিয়েই শুরু ভারত-দর্শন, পরের দিন গন্তব্য ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন। রাষ্ট্রপতি ভবনটি তৈরির পরিকল্পনা হয়েছিল ১৯১১ সালে কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্তের পর। ব্রিটিশ শাসনামলে এটি ছিল ভাইসরয় হাউজ। ১৯৫০ সালে রাজেন্দ্র প্রসাদ ভারতের প্রথম প্রেসিডেন্টের সময় এর নাম হয় রাষ্ট্রপতি ভবন। দেশটির প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতিকে কাছ থেকে দেখা অনেকটা স্বপ্নের মতো। ফটোসেশনের পর তাঁর আতিথেয়তা।
আর প্রেসিডেন্টের গার্ডের নান্দনিক কুচকাওয়াজ উপভোগ তো রাজসম্মান। তাই ৬ অক্টোবর মঙ্গলবার দিনটি বাংলাদেশের শত তরুণের জীবনে এক স্মরণীয় দিন। শুরুতেই বাংলা ভাষার চমক। আমাদের চমকে দিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বলে ওঠেন, আমি কিন্তু নড়াইলের জামাই। শ্বশুরালয়ের স্নেহাস্পদদের আপন করে নিলেন জামাইবাবু। তারপর মিষ্টি হেসে বললেন, দিনকে দিন গভীরতর হচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্ব। আরো এগিয়ে যাবে সম্প্রীতির এ বন্ধন। বাংলাদেশকে উন্নয়নের সোপানে তুলতে তরুণ প্রজন্মের স্বপ্নকে বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়ে বললেন, এ জন্য উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। তরুণরাই কাণ্ডারি, তারাই ভবিষ্যৎ, তারাই একদিন দেশের হাল ধরবে। তাঁর কথাগুলো আমাদের সামনে চলার পথে তাৎক্ষণিক অনুপ্রেরণা দেয়। সাক্ষাতে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাশে থাকার স্মৃতিচারণাও করেন।
শিল্প-সংস্কৃতির কোনো সীমানা নেই, সেই কথাও মনে করিয়ে দেন আমাদের। প্রণব মুখার্জি আমাদের সম্বোধন করলেন বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রজন্ম নামে। আমাদের নিমন্ত্রণ করায় তাঁর দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানান। বলেন, তিনি চতুর্থবারের মতো তরুণ বন্ধুদের সঙ্গে দেখার সুযোগ পেলেন। রাষ্ট্রপতি ভবনের দিকে ইঙ্গিত করে আমাদের বলেন, শুধু এই ভবন নয়, ভারতের ১৩তম রাষ্ট্রপতির ওপরও দাবিদার আপনারা।
বাসের বদলে মেট্রোরেল, কিছু সময়ের জন্য ঘুরে দেখা। দিল্লিজুড়ে মোট ১৩৭টি মেট্রো রেলস্টেশন। ১৮৯ কিলোমিটারে সাতটি অপারেশনাল লাইন। প্রতি ৩ থেকে ৪ মিনিট পরপর মেট্রো। এক মিনিটের মধ্যে যাত্রী ওঠানামা করে। এরপর আবার স্টেশন ছেড়ে যায়। মেট্রোতে ভ্রমণের মাধ্যমে বাংলাদেশের তরুণদের ধারণা হয় কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে আধুনিক দিল্লি। দিল্লিতে রাজধানী স্থাপনের পর সম্রাট শাহজাহান এই রেডফোর্ট নির্মাণ করেছিলেন। এটি নির্মাণ করা হয়েছে আগ্রার লালকেল্লার আঙ্গিকেই। মুঘল শাসকদের বিলাসিতা আর আভিজাত্যের নিদর্শন মেলে এই কেল্লা থেকে। রেডফোর্টের পরবর্তী গন্তব্য ইন্ডিয়া গেট।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় ছিনিয়ে আনতে যেসব ভারতীয় সেনা জীবন দিয়ে ছিলেন, তাঁদের স্মরণে এই ইন্ডিয়া গেটে স্থাপন করা হয়েছে ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’। এর আগে পঞ্চম জর্জের একটি মূর্তি এই স্মৃতিসৌধের ছাউনি নিচে ছিল। ছাউনির তলাটি এখন ফাঁকা। সেই মূর্তিটি অন্যান্য মূর্তির সঙ্গে দিল্লির করোনেশন পার্কে সরিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৩১ সালে নির্মিত এই সৌধটির নকশা করেন স্যার এডউইন লুটিয়েনস। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে দেখা যায় এই সুউচ্চ গেটি। বিশেষ করে গোধূলি বেলায় এর সৌন্দর্য দেখে দর্শনার্থীরা। আর গেটের মাথার ওপর আকাশের সোনালি আলো খেলা করে সারাবেলা। প্রতিদিনই দেশি-বিদেশি পর্যটকরা আসেন এই সুন্দর গেট দেখতে। এখানে বাহারি পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা।
এরপর যাত্রা শুরু কুতুব মিনারের উদ্দেশে। দিল্লি থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে কুতুব মিনার বিশ্বের সর্বোচ্চ ইট নির্মিত মিনার। আশপাশে অনেক প্রাচীন, মধ্যযুগীয় স্থাপনা ও ধ্বংসাবশেষ। সব মিলিয়ে বলা হয় কুতুব কমপ্লেক্স। ভারতের প্রথম মুসলমান শাসক কুতুবদ্দিন আইবেকের আদেশে এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু তিনি মিনারের কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। পরে ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৮৬ খ্রিস্টাব্দে মিনারের বাকি কাজ শেষ করেন। কুতুব মিনারটি বিভিন্ন নলাকার আদলে গঠিত যা বারান্দার দ্বারা পৃথকীকৃত। মিনার লাল বেলে পাথর দিয়ে তৈরি যার আচ্ছাদনের ওপর পবিত্র কোরআনের আয়াত খোদাই করা। কুতুব মিনারের দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে ২৫ ইঞ্চি ঢাল আছে, যা নিরাপদ সীমার মধ্যে বিবেচিত। আফগানিস্তানের জাম মিনারের অনুকরণে এটি নির্মিত হয়। পাঁচতলা বিশিষ্ট মিনারের প্রতিটি তলায় রয়েছে ব্যালকনি বা ঝুলন্ত বারান্দা।
১০০ একর জমির ওপর স্থাপিত এ কমপ্লেক্সে রয়েছে কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদ, আলাই মিনার, আলাই গেট, সুলতান ইলতুৎমিশ, সুলতান গিয়াস উদ্দীন বলবন, সুলতান আলাউদ্দিন খলজী ও ইমাম জামিনের সমাধি ও লৌহ পিলার। এ ছাড়া মিনারের প্রাচীর গাত্র নানা প্রকারের অলঙ্করণ দ্বারা শোভিত। কুতুব মিনারটির উচ্চতা ৭২.৫ মিটার। মিনারের অভ্যন্তরে উপরে উঠার সিঁড়ি রয়েছে ৩৭৯টি। নিচের দিকে মিনারের আয়তন ১৪.৩ মিটার এবং উপর দিকে ব্যাস ২.৭৫ মিটার। দিল্লি শহর থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এই কুতুব মিনার।
কুতুব মিনার থেকে হোটেলে ফেরে তরুণ প্রতিনিধিদলের গাড়িবহর। ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সৌজন্যে রাতে হোটেলে যুব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নৈশভোজ। বাংলাদেশের প্রতিভাবান প্রতিনিধিদের একের পর এক পরিবেশনা। অন্যদিকে ভারতের ঐতিহ্যবাহী নাচ ও গান পরিবেশন করেন বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা তরুণ শিল্পীরা। এরপর বাসেই চলে নাচগান। গানের তালে গাড়িবহর পৌঁছে আগ্রা। তারপর তাজমহল যাওয়ার পালা। বাস থামে তাজমহলের গেট থেকে কিলোমিটার খানেক দূরে। সেখান থেকে ব্যাটারিচালিত মিনিবাসে তাজমহলের গেটের সামনে নামে ১০০ তরুণ-তরুণী। এরপর লাইন ধরে তাজমহলে প্রবেশ। সঙ্গে তিনজন গাইড। গাইডদের মুখে শোনা যায় তাজমহল নির্মাণের ইতিহাস।
তাজমহলের চত্বরটি বেলে পাথরের দুর্গের মতো দেয়াল দিয়ে তিন দিকে ঘেরা। নদীর দিকের পাশটিতে কোনো দেয়াল নেই। এই দেয়াল বেষ্টনীর বাইরে আরো সমাধি রয়েছে। এর মধ্যে শাহজাহানের অন্য স্ত্রীদের সমাধি। রয়েছে মমতাজের প্রিয় পরিচারিকাদের একটি বড় সমাধিও। এসব স্থাপত্য প্রধানত লাল বেলে পাথরে তৈরি। ১৬৩১ অব্দে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতাপশালী সম্রাট শাহজাহান তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মমতাজের মৃত্যুতে প্রচণ্ডভাবে শোকাহত হয়ে পড়েন। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে শাহজাহান দ্রুত তাজমহলের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। মূল সমাধিটি সম্পূর্ণ হয় ১৬৪৮ অব্দে এবং এর চারদিকের ইমারত এবং বাগান আরো পাঁচ বছর পর নির্মিত হয়। তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হলো, এত পুরোনো তবুও আধুনিক! নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা, আর চিরকালের বিস্ময়কর এ স্থাপনা কল্পনার চেয়েও সুন্দর! তাজমহল দেখার মুগ্ধতা নিয়ে আমরা যাই দ্রোণাচার্য প্রকৌশল কলেজ দেখতে। সেটাও দারুণ এক অভিজ্ঞতা।
৮ অক্টোবর রাজস্থানে আমরা সাক্ষাৎ করি ভারতের যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী গজেন্দ্র সিং খিসার সঙ্গে। তাঁর উষ্ণ অভ্যর্থনা আমাদের মুগ্ধ করে। এরপর উত্তর প্রদেশের ফতেপুর সিক্রিতে বুলন্দ দরজা দর্শন। সেখান থেকে আগ্রার লাল দুর্গ। বিস্ময় আর মুগ্ধতার ঘোর যেন কাটতে চায় না শত তরুণ-তরুণীর।
তারপর আমরা যাই বাঙালি শহর কলকাতায়। সেখান থেকে শান্তি নিকেতনে। যেখানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাটিয়েছেন সোনালি কৈশোর। আজও সেখানকার প্রকৃতির মাঝে ফুটে ওঠে বিশ্বজয়ী কবির সবুজ মন আর সমৃদ্ধ রঙিন জীবনের প্রতিচ্ছবি।
কলকাতা থেকে ১৫৯ কিলোমিটার দূরত্বে বীরভুম জেলার বোলপুরে অবস্থিত কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত শান্তির এ জগৎ। মূলত এটি একটি আশ্রম ও শিক্ষাকেন্দ্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিভৃতে ঈশ্বরচিন্তা ও ধর্মালোচনার জন্য ১৮৬৩ সালে এখানে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কবি এখানে প্রথম এসেছিলেন ১২ বছর বয়সে। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, পরে ১৯২১ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয়। শান্তিনিকেতন ভবন আশ্রমের সবচেয়ে পুরোনো বাড়ি। এখানে সব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত পাঁচটি বাড়ি রয়েছে। উত্তর কোণে বিচিত্রা ভবন। শুভ্র ভবনের দোতলায় রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি নিয়ে গড়ে উঠেছে জাদুঘর। জাদুঘরে কবির ব্যবহৃত ফুলদানি থেকে শুরু করে নিজ হাতে তৈরি কাঠের বাক্সসহ নানা উপহার। উদয়ন, কবিগুরুর আরেক বাসভবন। এখানে বসেই কবি আশ্রমবাসী ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে কবিতা পাঠ, নাটক ও জলসার আয়োজন করতেন।
এরপর চোখের সামনে পড়ে শ্যামলী নামের সুন্দর বাড়িটি। পাশেই সযত্নে রাখা আছে কবির ব্যবহৃত গাড়ি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখা কবির স্মৃতিগুলো। এরপর কলকাতায় নিউমার্কেট। সেখানে স্বাচ্ছন্দ্যে সবার কেনাকাটা। তারপর হোটেলে খাওয়া। পরে বাসে করে এয়ারপোর্টের দিকে যাত্রা। পথে নজর কাড়ে গঙ্গার ওপরে হাওড়া ব্রিজ ও সল্টলেকের মনোরম দৃশ্য। সন্ধ্যায় এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে ঢাকার উদ্দেশে কলকাতা ছাড়ে বাংলাদেশের তরুণরা।