পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে পর্যটক ও ভ্রমণকারীদের ১৫টি টিপস

Looks like you've blocked notifications!
ছবি : ফ্রিপিক

পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগই পানি হওয়ায় প্রাণোচ্ছ্বল গ্রহটির সৌন্দর্য্যের পরিমাণও যেন পানিতেই বেশি। আর তার টানেই বিশ্বব্যাপী ভ্রমণপিপাসুরা ছুটে যান খাল-বিল, নদী-নালা ও সাগর সৈকতে। কিন্তু এই মায়ার ভেতরেও লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর ঝুঁকি। মনোরম জলীয় সৌন্দর্য্যে অবগাহনের সময় এমনকি ছোট সুইমিং পুলটিও আশঙ্কাজনক বিপদগুলোকে ছাপিয়ে যেতে পারে। তবে এটা দুঃখজনক যে পর্যটক ও ভ্রমণকারীদের পানিতে ডুবে মৃত্যু উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।

এ রকম দুর্ঘটনা পরিবার তো বটেই, গোটা দেশবাসীর জন্য আশঙ্কাজনক। তাই প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করার জন্য প্রতিটি দুর্ঘটনার পিছনের সুষ্পষ্ট কারণগুলো যাচাই করা আবশ্যক। যে বিষয়গুলোর ওপর মানুষের হাত নেই, সেগুলোকে তাৎক্ষণিকভাবে নির্মূল করা সম্ভব নয়। এর জন্য ক্ষতি যথাসম্ভব কমিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন পূর্ব সচেতনতা। আর যে কারণগুলোর ওপর মানুষের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার ওপর জোর আরোপ করা। আর এই লক্ষ্যেই এই নিবন্ধে পানিতে ডুবে মৃত্যু এড়াতে ভ্রমণকারীদের প্রয়োজনীয় সতর্কতা সম্পর্কিত নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে। চলুন, পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঝুঁকি প্রতিরোধে সতর্কতামূলক পদক্ষেপগুলোর বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।

নির্ধারিত নিরাপদ অঞ্চলে সাঁতার কাটা

নিরাপত্তা ও উপভোগের জন্য বিশেষভাবে নির্ধারিত এলাকায় সাঁতার কাটুন। সৈকত এবং নদীর তীরবর্তী স্থানে প্রায়ই বিভিন্ন সংকেতের পতাকা দেখা যায়। এগুলো সেই স্থানের দুর্ঘটনা প্রবণতা চিহ্নিত করে।

এ সংকেতগুলো মেনে নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে সাঁতার কাটা উচিত। এই সীমানাগুলো সাঁতারের জন্য শুধু নিরাপদই নয়; এগুলোর মাঝে থাকলে বিশেষত একজন যোগ্য লাইফগার্ডের সজাগ দৃষ্টি সীমার মধ্যে থাকা যায়।

সহসা কোনো অনিশ্চিয়তায় সঙ্গে সঙ্গেই ডাঙায় ফিরে আসা

সাঁতার কাটার সময় চারপাশে অথবা নিজের শরীরে হঠাৎ কোনো অসঙ্গতি অনুভূত হলে তাৎক্ষণিকভাবে ডাঙায় ফিরে আসুন। এটা হতে পারে স্রোত তীব্র হওয়া, প্রচণ্ড বেগে বৃষ্টিপাত শুরু হওয়া কিংবা শরীরে হঠাৎ মাত্রাতিরিক্ত ক্লান্তি ভাব হওয়া।

কখনও কখনও আসন্ন কোনো বিপদের ব্যাপারে মন আগে থেকেই জানান দিতে শুরু করে। মনে রাখবেন, যে কোন সমস্যায় নিজের সহজাত প্রবৃত্তির ওপর বিশ্বাস রাখাটা বুদ্ধিমান সিদ্ধান্ত।

আবহাওয়া ও পানির অবস্থা সম্বন্ধে অবগত থাকা

পানিতে নামার আগে সেখানকার তাপমাত্রা ও আবহাওয়ার অবস্থা পরীক্ষা করার জন্য কিছুক্ষণ সময় নিন। পানিপথে যাত্রা অথবা উপকূল অঞ্চলে ভ্রমণের জন্য অবশ্য বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়েই আবহাওয়ার ব্যাপারে জেনে নেওয়া উচিত।

হালকা বৃষ্টি অথবা বৃষ্টিহীন বজ্রপাতেও পানিতে থাকবেন না। বর্ষাকালের মত আবহাওয়ার অপ্রত্যাশিতভাবে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দ্রুত সাঁতার কেটে তীরে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকুন।

সাঁতরানোর সময় কাউকে সঙ্গে নেওয়া

বন্ধুদের সঙ্গে একত্রে সাঁতার কাটা শুধু সময়টাকে উপভোগ্য করে তোলে না; পরস্পরের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও এটা উত্তম। পানিতে থাকা অবস্থায় আপনার বন্ধুটি যখন আপনার জন্য সতর্ক থাকবেন, ঠিক সে সময় আপনার উপস্থিতিটাও তাকে নির্ভরতা দিবে।

ঠিক এই কাজটি প্রায়ই নিঃসঙ্গ সাঁতারুদের ক্ষেত্রে লাইফগার্ডরা করে থাকেন। তাই পানিতে নামার পূর্বে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের জন্য হালকা সৌজন্য করতেও দ্বিধা করবেন না।

সাঁতারে দক্ষ হয়ে ওঠা

সাগরীয় অঞ্চল বা নদী বিধৌত যে কোনো জায়গায় ভ্রমণের আগে সাঁতার জানাটা জরুরি। নিদেনপক্ষে মুক্ত পানিতে ঘুরে বেড়ানোর মত মৌলিক দক্ষতাগুলো জানা থাকা উচিত।

আপনি সাঁতারে যতই পারদর্শী হয়ে উঠবেন, অজানা জলীয় পরিবেশে আপনার আত্মবিশ্বাস ততটাই বাড়বে। আর পানির নিচে প্রখর মানসিকতা একটি দরকারি বস্তু। তাছাড়া এটি অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনাগুলো প্রতিরোধের জন্য এটি মোক্ষম উপায়গুলোর মধ্যে একটি।

লাইফ জ্যাকেট পরিধান করা

ছোট বাচ্চা ও অনভিজ্ঞ সাঁতারুদের জন্য পানিতে নামার সময় কোস্টগার্ড-প্রত্যয়িত লাইফ জ্যাকেট পরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সব ধরনের জলাশয়ে জীবন রক্ষার জন্য সেগুলো উপযুক্ত নয়, এরপরেও নূন্যতম নিরাপত্তার ব্যাপারে স্বল্প হলেও এটা একটা ভালো সংযুক্তি।

এগুলো পরিধান করার পরেও শিশু, বৃদ্ধি ও অনভিজ্ঞ সাঁতারুদের তাদের অভিভাবক বা অভিজ্ঞ কারো হাতের নাগালের মধ্যে রাখা উচিত। মনে রাখবেন, লাইফ জ্যাকেট শুধুমাত্র একটি অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা; পানিতে থাকা অবস্থায় অন্যান্য সুরক্ষা অনুশীলনের বিকল্প নয়।

স্রোত কতটা প্রবল তা বোঝা

অশান্ত পানির প্রবলতর হওয়ার মাত্রা বুঝতে পারা অভিজ্ঞ সাঁতারুর একটি দক্ষতা। পানির এমন অবস্থায় সৃষ্ট তরঙ্গ সাঁতারের পথ থেকে সাঁতারুকে সরিয়ে দিতে পারে। যে কোনো বিচ্যুতির ব্যাপারে সচেতন থাকার জন্য রেফারেন্স হিসেবে কাছাকাছি কোনো নৌকা বা তীরের একটি নির্দিষ্ট জায়গাকে নির্বাচন করুন।

এই কাজটি আপনি অতিরিক্ত দূরে ভেসে যাচ্ছেন কিনা সে ব্যাপারে আপনাকে জানতে সাহায্য করবে। জোয়ার-ভাটায় পড়ে গেলে শান্ত থাকুন এবং এর টান এড়াতে তীরের সমান্তরালে সাঁতার কাটুন। স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটা ক্লান্তি ও আতঙ্কের কারণ হতে পারে।

যে কোনো জরুরি অবস্থার জন্য প্রস্তুত থাকা

পানিতে নামার আগে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা করুন। আপনি যে পানিতে নামতে যাচ্ছেন, সে ব্যাপারে বন্ধু অথবা স্থানীয় দায়িত্বরত কাউকে জানিয়ে রাখুন।

সম্ভব হলে উপকূলে আপনার জন্য আলাদাভাবে একজন পর্যবেক্ষক রাখতে পারেন, যিনি প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারবে। এসব ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব অনিশ্চয়তা থেকে দূরে থাকুন। এই পূর্ব পরিকল্পনার অনুশীলনটি শুধু আপনার নিজের জন্য নয়; আপনার আশেপাশের মানুষদেরও উপকারে আসবে।

পানির নিচের প্রতিকূলতা সম্পর্কে সতর্ক থাকা

পানির নিচের জগতটি শত শত উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল। এগুলো পানির ভেতরে বেঁচে থাকার জন্য তৈরি, যা মানুষের শারীরবৃত্তির সঙ্গে একদমই সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

তাই এই রোমাঞ্চকর জগতকে উপভোগের সময় বিপজ্জনক পাথর, সামুদ্রিক শৈবালসহ বিভিন্ন প্রাণী ও ধ্বংসাবশেষের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন।

আশেপাশের এলাকা বুঝে নিতে সাঁতারে কিছুক্ষণ পরপর বিরতি নিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিন যে এলাকাটি বিপদমুক্ত কিনা।

শিশুদেরকে জল নিরাপত্তাগুলো শেখানো

বাচ্চাদের এই করণীয়গুলো শেখানোর ব্যাপারে সহজ-সাবলীলতা ও আকর্ষণীয় পদ্ধতি অবলম্বন করুন। নিয়ম ও নির্দেশিকাগুলো শুধু অনুসরণই নয়, সেগুলোর পিছনের কারণগুলো বুঝিয়ে বলুন।

লাইফ ভেস্ট পরা, অভিভাবকের তত্ত্বাবধান ছাড়া সাঁতার না কাটা এবং গভীর বা ঘোলা পানি এড়িয়ে চলার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করুন।

শিখন প্রক্রিয়ার সময় উন্মুক্ত যোগাযোগ বাচ্চাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জানা তত্ত্বগুলো প্রয়োগ করার ক্ষমতা প্রদান করবে। এটি একদম রাস্তা পার হওয়ার আগে বাচ্চাদের দুই দিকেই তাকাতে শেখার মত।

জীবন রক্ষার উপায়গুলোতে রপ্ত হওয়া

সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের পরেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই আগে থেকেই জীবন রক্ষাকারী পদ্ধতিগুলো শিখে রাখুন। প্রয়োজনে জল-সম্পর্কিত দুর্ঘটনায় প্রাথমিক প্রাথমিক চিকিৎসা শেখার কোর্সে ভর্তি হতে পারেন।

বিশেষ করে ফুসফুস থেকে পানি বের করার পদ্ধতি, চিকিৎসা শাস্ত্রে যাকে সিপিআর (কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন) বলা হয়- তা শিখে নেয়া জরুরি। এর সঙ্গে যে কোনো ছোট আঘাতের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাথমিক চিকিৎসা করাটাও অন্তর্ভূক্ত রাখুন।

পানিতে পা দিয়ে ঝাঁপ দেয়া

সুইমিং পুল, নদী এমনকি সাগরের পানিতেও অনেকেই সাঁতরানোর আগে উল্টোপাল্টা বিভিন্ন কসরতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এটি কখনো উচিত নয়; বিশেষ করে পানি যেখানে অগভীর সেখানে বিপদ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

চার ফুটের কম গভীরতা পানি পা, গোড়ালি, ঘাড়, এমনকি মাথাতেও আঘাতের ঝুঁকি তৈরি করে। অনেক সময় একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার সময় পানিতে বেকায়দায় শরীর পড়তে পারে।

ঝাঁপিয়ে পড়ে পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার ক্ষেত্রে সব সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন প্রথমে পা পানিতে পড়ে। নিরাপদে ডাইভিং করার জন্য ন্যূনতম চার ফুট গভীরতার এলাকাগুলো বেছে নিন।

উদ্ধার কাজে সতর্ক থাকা

পানিতে কাউকে ডুবে যেতে দেখে প্রশিক্ষিত একজন লাইফগার্ড না হয়েও তাকে বাঁচাতে ঝাঁপ দিতে যাবেন না। আতঙ্কিত ব্যক্তি ভেসে থাকার চেষ্টা করার সময় অসাবধানতাবশত আপনাকে পানির নিচে টানতে থাকবে। এতে তাকে বাঁচানো তো যাবেই না, বরং আপনার নিজেরও প্রাণনাশের উপক্রম হবে।

তাই বরং এমন একটি বস্তু শনাক্ত করুন, যেটি পানিতে ভালভাবে ভেসে থাকতে পারে। অতঃপর সেটিকে একটি দড়িতে শক্ত করে বাঁধুন।

এবার দড়ির একপ্রান্ত হাতে শক্ত করে ধরে বস্তুটিকে ডুবন্তপ্রায় ব্যক্তির কাছে নিক্ষেপ করুন।

এবার তাকে বস্তুটি শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে বলুন। তিনি তা আঁকড়ে ধরতে সমর্থ হলে দড়ি টেনে তাকে নিরাপদ অবস্থানে নিয়ে আসুন।

স্থানীয় জল নিরাপত্তা নিয়মগুলো যথাযথ মেনে চলা

সুইমিং পুল ও সৈকতে প্রদর্শিত জল সুরক্ষা নিয়মগুলো সম্পর্কে অবগত হয়ে তা সঠিক ভাবে মেনে চলা উচিত। এই নির্দেশিকাগুলো সর্বদা স্থানীয় সম্ভাব্য বিপদগুলো থেকে দর্শনার্থীদের সতর্ক থাকার দিকে তাগিদ করে।

কোনো নির্দেশিকা না থাকলেও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এমন বিপদের ব্যাপারে জেনে নিন। বিপদের ব্যাপারে না জানলেও কখনও রাতের অন্ধকারে পানিতে নামবেন না।

সাঁতারের পূর্বে পাকস্থলিকে সুস্থ রাখা

পানির নিচের অভিজ্ঞতা আরামপ্রদ করার ক্ষেত্রে সাঁতারের পূর্বে খাদ্য নির্বাচনে সচেতন হন। সাঁতারের আগে উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার, বিশেষ করে আইসক্রিম খাওয়ার ফলে বদহজম ও অস্বস্তি হতে পারে।

পানিতে দেহের আনুভূমিক অবস্থান অ্যাসিড রিফ্লেক্সকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। আর মশলাদার খাবার এর অনুকূলে কাজ করে সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

চিনিযুক্ত সোডা বা ফলের রস, কফি, ও দানাদার খাবার উদরাময় ঘটাতে পারে। এটি সাঁতারের সময় নির্দিষ্ট স্পন্দন বজায় রেখে শ্বাস-প্রশ্বাস সচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।

প্রসঙ্গত, অচেনা জায়গায় দীর্ঘ ভ্রমণ রোমাঞ্চকর, যেখানে মুক্ত পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঝুঁকি এড়াতে পর্যটক ও ভ্রমণকারীদের করণীয় মেনে চলাটা ভ্রমণকে করে তুলতে পারে আরও আরামপ্রদ।

নিদেনপক্ষে, নদী বা সাগরীয় অঞ্চলে ঘুরে বেড়ানোকে আরও নিশ্চিন্ত করে তুলতে পারে এই সতর্কতাগুলো। পৃথিবীর নৈসর্গিক স্থানের সান্নিধ্যে গিয়ে জীবনকে শুধু সুন্দর করা নয়; নিরাপদে রাখাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।