ইকবাল সন্দেহে আটক যুবককে কুমিল্লা পুলিশ লাইনসে নেওয়া হয়েছে
কুমিল্লা শহরের নানুয়া দিঘীর পাড়ের পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখার ঘটনায় ইকবাল হোসেন সন্দেহে এক যুবককে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে কক্সবাজার থেকে আটক করা হয়। এরই মধ্যে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে আজ শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে তাঁকে কুমিল্লা পুলিশ লাইনসে নেওয়া হয়েছে। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আটক ওই যুবকই ইকবাল হোসেন। এ ব্যাপারে বিস্তারিত পরে জানানো হবে বলেও জানিয়েছে পুলিশ।
এর আগে আজ ভোর সাড়ে ৬টার দিকে কক্সবাজার থেকে কড়া নিরাপত্তার মাধ্যমে ওই যুবককে নিয়ে কুমিল্লার উদ্দেশে রওনা দেয় পুলিশ।
কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) এম তানভীর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, আমরা তাঁকে (ইকবাল সন্দেহে আটক যুবক) রিসিভ করেছি। এখন তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। যে প্রোসেসগুলো আছে, সবকিছু শেষ করব। এরপর যথাসময়ে আপনাদের সবকিছু জানানো হবে। সবাই আপনারা সহযোগিতা করেছেন। এ ঘটনার কারণে জাতিগতভাবে আমাদের যে সমস্যা হয়ে গিয়েছিল, আমরা চাই সবাই সম্প্রীতি বজায় রাখব। আপনাদের সহযোগিতা আমাদের অনেক সাহস যুগিয়েছে।’
এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজার সৈকত এলাকার সুগন্ধা পয়েন্ট থেকে ইকবাল সন্দেহে ওই যুবককে আটক করা হয়। এরপর গতকাল রাতে তাঁকে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম এসব তথ্য নিশ্চিত করে জানান, বৃহস্পতিবার রাতে এক যুবক সৈকত এলাকায় ঘোরাফেরা করার সময় জেলা পুলিশের একটি দল ইকবাল সন্দেহে তাঁকে আটক করে। এরপর পুলিশ সুপার কার্যালয়ে নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আজ শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে কুমিল্লা জেলা পুলিশের একটি দল কক্সবাজারে আসে। এরপর সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ইকবালকে কুমিল্লা জেলা পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এরপরই কুমিল্লা জেলা পুলিশের ওই দল ইকবালকে নিয়ে কুমিল্লার পথে রওনা দেয়।
এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা পুলিশ আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমকে জানাবে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম।
এদিকে গতকাল পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মোহাম্মদ শাহ জালাল স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত ১৩ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৭টায় কুমিল্লার সদর থানাধীন নানুয়া দীঘির উত্তর পাড়ে দর্পণ সংঘের অস্থায়ী পূজামণ্ডপে মূর্তির পায়ের ওপর কে বা কারা পবিত্র কোরআন শরিফ রেখে চলে যায়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কতিপয় স্বার্থান্বেষী দুষ্কৃতকারী উসকানিমূলক ও বিকৃত প্রচারণা চালায় এবং পরবর্তী সময়ে আরও উচ্ছৃঙ্খল দুষ্কৃতকারী সংঘবদ্ধ হয়ে মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুরের চেষ্টা ও পূজামণ্ডপে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এ ছাড়া, দুষ্কৃতকারীরা শহরের কাপড়িয়া পট্টি কলোনির চানমনি পূজামণ্ডপ, শ্রী শ্রী রক্ষাকালী মন্দির, কালিতলাসহ আরও কয়েকটি পূজামণ্ডপে হামলা চালায় এবং প্রতিমায় অগ্নিসংযোগ করে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কুমিল্লার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে সেজন্য সারা দেশে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে এবং গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বোচ্চ সতর্কতা এবং প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন স্থানে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে গত ১৩ অক্টোবর রাত সাড়ে ৮টায় চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ পৌরসভার শ্রী ত্রিনয়নী সংঘ রাজা লক্ষ্মী নারায়ণ জিউর আখড়া, মোকিমাবাদ পূজামণ্ডপে ৫০০ থেকে ৬০০ দুষ্কৃতকারী দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। পুলিশ তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে তারা পুলিশের ওপর হামলা করে এবং পাঁচ থেকে ছয়টি পূজামণ্ডপ ভাঙচুর করে। দুষ্কৃতকারীদের ইট-পাটকেলের আঘাতে ১৫ জন পুলিশ সদস্য মারাত্মক আহত হয়। জনগণের জানমাল রক্ষায় এবং আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় পাঁচজন প্রাণ হারায়।
কুমিল্লার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় গত ১৪ অক্টোবর বেলা ১১টা ২০ মিনিটে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার ছয়ানী ইউনিয়নের সর্বজনীন শ্রী শ্রী দুর্গা পূজা মন্দিরের কাছে ৮০০ থেকে এক হাজার উচ্ছৃঙ্খল লোক জড়ো হয়ে উসকানিমূলক স্লোগান দিতে থাকে। একপর্যায়ে তারা অসংখ্য ইট, লাঠিসোটা নিয়ে মন্দিরের সামনে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ ও বিজিবির টহল দলের ওপর হামলা চালায়, মন্দিরের মূর্তি ভাঙচুর করে এবং মন্দিরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় একজন প্রাণ হারায় এবং পরে পুকুর থেকে আরেকজনের লাশ উদ্ধার করা হয় বলেও বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, গত ১৭ অক্টোবর রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বড় করিমপুর মাঝিপাড়া গ্রামের পরিতোষ (১৯) তাঁর ফেসবুক আইডিতে পবিত্র কাবা শরিফের অবমাননাকর ছবি আপলোড করেন। পরবর্তীতে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। এরপর রাত প্রায় ৮টার দিকে এলাকার কতিপয় দুষ্কৃতকারী ওই গ্রামের একটি মন্দিরসহ ১৮টি পরিবারের ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
এ ছাড়া কক্সবাজারের পেকুয়া ও চকরিয়া উপজেলা, সিলেটের জকিগঞ্জ, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া ও কমলগঞ্জ, হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ এবং গাজীপুর মহানগরের কাশিমপুরসহ দেশের আরও কয়েকটি স্থানে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ সব ঘটনায় সারা দেশে সাতজন প্রাণ হারায়। তার মধ্যে দুজন হিন্দু সম্প্রদায়ের এবং পাঁচজন মুসলিম সম্প্রদায়ের। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দায়িত্ব পালনকালে ৫০ জন পুলিশ সদস্য আহত হন বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, সংঘটিত এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ৭২টি মামলা করা হয়েছে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৪৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও মামলা রুজু প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এবং দুষ্কৃতকারীদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে। ঘটনা/অপরাধের রহস্য উদঘাটনের জন্য থানা পুলিশের পাশাপাশি পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটগুলোকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। দ্রুততার সঙ্গে ঘটনা/অপরাধের রহস্য উদঘাটনে প্রযুক্তি নির্ভর তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ও উসকানি রোধকল্পে সাইবার মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। পরিস্থিতির অবনতি রোধকল্পে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকারের সব গোয়েন্দা সংস্থা সার্বক্ষণিকভাবে কড়া নজরদারি অব্যাহত রেখেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, যেকোনো বিভ্রান্তিকর তথ্য অথবা গুজব কিংবা উসকানিতে বিভ্রান্ত বা উত্তেজিত না হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে নিকটস্থ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করা এবং পরিস্থিতির উন্নয়নে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য দেশের সব নাগরিকের প্রতি বিশেষ অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ।