এসিল্যান্ড ও সাব রেজিস্ট্রি অফিসে পদে পদে হয়রানি
দেশের বিভিন্ন এলাকার এসিল্যান্ড অফিসে পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বাদ নেই ভূমি জরিপ অধিদপ্তর, সাব রেজিস্ট্রি অফিসও। জমির নিবন্ধন, নামজারি, শ্রেণি পরিবর্তনে পোড়াতে হয় কাঠখড়। এ ছাড়া অসৎ উদ্দেশে খাজনা নেওয়া বন্ধ, দীর্ঘদিনেও মামলা নিষ্পত্তি না হওয়াসহ রয়েছে অন্যান্য কাজে দীর্ঘসূত্রিতা। বর্তমানের এমন দৃশ্য চার বছর আগেও ছিল প্রায় একই, দাবি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)। এমন সূত্র ধরে দেশের কয়েকটি এসিল্যান্ড অফিসে এনটিভি অনলাইন সরেজমিনে গেলে নতুন করে উঠে আসে হয়রানির আরও সব চিত্র, পাওয়া যায় ভোগান্তির অভিযোগ।
ঢাকা, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি এসিল্যান্ড অফিসে ভোগান্তির শিকার ব্যক্তিদের অভিযোগ থেকে জানা যায়, সরাসরি সেবার পরিবর্তে সিন্ডিকেট ও দালালচক্রের মাধ্যমে উৎকোচের বিনিময়ে চলে সেবা। ভূমি অফিসের নিচে থাকে পিয়ন। তার ওপরে তহসিলদার ও কানুনগো তো আছেনই। দূর থেকে লক্ষ্য রাখেন তাঁরা। কখনও কখনও সরাসরিও যোগাযোগ করেন সেবাপ্রত্যাশীদের সঙ্গে। কোনো কোনো এসিল্যান্ডের বিরুদ্ধেও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।
রাজধানীর ডেমরা ও মতিঝিল সার্কেলের এসিল্যান্ড অফিস টয়েনবি সার্কুলার রোডের জয়কালি মন্দির এলকায়। নিচতলায় মতিঝিল ও দ্বিতীয় তলায় ডেমরা রাজস্ব সার্কেলের ভূমি সহকারি কমিশনারের কার্যালয়। বৃহস্পতিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সকল প্রকার হয়রানি বন্ধে সাইন বোর্ডে লিখে দেওয়া হয়েছে নামজারির ক্ষেত্রে এক হাজার ১০০ টাকা। আর রেজিস্ট্রেশনের খরচ ৭০ টাকা। দুটি অফিসের এসিল্যান্ডের কক্ষের সামনে লেখা ‘সবার জন্য এসিল্যান্ডের দরজা খোলা।’
এসব দেখে মতিঝিল রাজস্ব সার্কেলের ভূমি সহকারি কমিশনার কার্যালয়ে যান এনটিভি অনলাইনের প্রতিবেদক। দেখেন ভিন্ন চিত্র। ওপরতলার অবস্থাও একই। সরকারি হিসেবে নামজারির ক্ষেত্রে এক হাজার ১০০ টাকা লেখা থাকলেও কাগজপত্রে ত্রুটি থাকলেই বেড়ে যাচ্ছে অঙ্কের পরিমাণ। দাবি করা হচ্ছে মোটা অঙ্ক। এ ছাড়া সেখানে আসা সেবাপ্রত্যাশীরা ফাইলপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা ছাড়া সই হচ্ছে না বলে অভিযোগ তোলেন।
ডেমরা থেকে নামজারির জন্য এসেছিলেন রবিউল হাসান। রেজিস্ট্রেশনের পর তাঁকে কাগজপত্র নিয়ে কানুনগো অফিসে শুনানির জন্য আসতে বলা হয়। কাগজপত্র ত্রুটি রয়েছে—এমন অজুহাতে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করা হয়।
এমন যখন চিত্র, তখন খোঁজ আসে, এক বীর মুক্তিযোদ্ধা জমি মিউটেশনের জন্য আবেদন করেছিলেন ২০০৯ সালে। সেটি সম্পন্ন হতে নাকি সময় লেগেছে প্রায় ১৩ বছর। ২০২২ সালে সম্পন্ন হয় কাজ।
ডেমরা কার্যালয়ের নানা অভিযোগ প্রসঙ্গে এবার যোগাযোগ করা হয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে। ডেমরা রাজস্ব সার্কেলের কর্মকর্তা মো. মোতাহার হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘কেউ নামজারিতে আমাদের এখানে কোনো ভোগান্তি নেই। আবেদন কাগজপত্র নিয়ে সরাসরি শুনানিতে অংশ নিতে পারবেন। কাগজপত্র সঠিক না থাকলে কানুনগো অফিস থেকে সেটাও বলে দেওয়া হয়।’
ডেমরা সার্কেলের সহকারি কমিশনার (ভূমি) এ এন এম আব্দুল্লাহ আল মামুন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদের দেশের অনেক মানুষের ভূমি সম্পর্কে তেমন কোনো জ্ঞান নেই। যে কারণে তাঁরা অন্যের ওপর নির্ভরশীল হন। এ ছাড়া ভূমি সম্পর্কিত তিনটি অফিসের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। যেমন- জরিপ করে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর, ল্যান্ড ট্রান্সফার বা দলিল রেজিস্ট্রি করে সাব রেজিস্ট্রার অফিস, এসিল্যান্ড অফিসে তথ্য হালনাগাদ, ভূমি উন্নয়ন কর ইত্যাদি নিয়ে কাজ করে। কিন্তু তিনটি অফিসের মধ্যে সমন্বয় নেই। এ ক্ষেত্রে এক জায়গায় দুর্বলতা থাকলে সেটির প্রভাব অন্যটির ওপর এসে পড়ে। যে কারণে ভূমি সেক্টরে ডিজিটালাইজেশন হলেও অনেক সমস্যা থেকে গেছে।’
এসিল্যান্ড আব্দুল্লাহ আল মামুন আরও বলেন, ‘এ অফিসে আমি যোগদান করেছি মাত্র তিন সপ্তাহ হয়েছে। আমার দরজা সব সময় সবার জন্য খোলা রয়েছে। যদি কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এসিল্যান্ড অফিসে এনটিভি অনলাইনের প্রতিবেদক গিয়ে দেখতে পায়, এক নারী নামজারির আবেদন করেছেন দেড় মাস আগে। এতদিনেও খতিয়ান বুঝে না পাওয়ায় গত ১৪ মার্চ চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এসিল্যান্ড অফিসে যান তিনি। কিন্তু, লাভ হয়নি। এসিল্যান্ড অফিসের কর্মচারী সুমন জানান, আরও সময় লাগবে।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই নারী বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে নামজারির আবেদন করেছি। নিয়ম অনুযায়ী ২৮ দিনের মধ্যে খতিয়ান বুঝে পাওয়ার কথা। কিন্তু, এখনও বুঝে পাইনি। এই নিয়ে কয়েক দফায় এসেছি। বার বারই বলছে আরও কয়েকদিন সময় লাগবে। যত বার আসছি, ততবারই টাকা নিচ্ছে।’
শুধু এই নারী নয়, আগ্রাবাদ ভূমি অফিসে নামজারিসহ ভূমি সংক্রান্ত সেবা নিতে গিয়ে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছে মানুষ। এই অভিযোগের পাশাপাশি ভুক্তভোগীরা জানান, নামজারির আবেদন করার পর দালাল ধরে ঘুষ না দিলে চার-পাঁচ মাসেও মেলে না খতিয়ান।
বিভিন্ন অভিযোগ থেকে জানা যায়, আগ্রাবাদ এসিল্যান্ড অফিসে নামজারিতে প্রতি ফাইলে পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ আদায়ে জড়িত রয়েছে একটি চক্র। দালালরা ঘুষ নেওয়ার পর একটি অংশ রেখে বাকি টাকা এসিল্যান্ড অফিসের কানুনগোর কাছে জমা দেন।
নাম অনিচ্ছুক আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, ‘টাকা পেলেই এসিল্যান্ড ফাইলে স্বাক্ষর করেন। না হয়, মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়। টাকা দেওয়ার বিষয়টি কাউকে বললে হয়রানির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেন। এটা ভুল, ওটা ভুল বলে মাসের পর মাস ঘুরাতে থাকেন। নামজারির একটি ফাইল নিয়ে আমাকে গত তিন মাস ধরে ঘুরাচ্ছেন।’
এ বিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) আগ্রাবাদ সার্কেল আল আমিন সরকার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমার অফিসের কেউ যদি হয়রানি করে তাহলে আমার কাছে এসে জানালে আমি ব্যবস্থা নেব। ‘একটি চক্র আমাদের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে। এসিল্যান্ডের কথা বলে অফিসের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারি ঘুষ আদায় করলে, তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব। আমি এ চক্রটিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।’
সরকারের খাস জমি ব্যক্তি মালিকানায় দেওয়া হচ্ছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে সে বিষয়ে আল আমিন সরকার বলেন, ‘মহানগর এলাকায় সরকারের কোনো খাস জমি নেই। এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ভূমি অফিসে দুর্নীতি প্রসঙ্গে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বাংলাদেশের ভূমি খাত আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত। টিআইবির পক্ষ থেকে ২০১৮ সালে আমরা একটি জরিপ চালিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলাম। সেই প্রতিবেদনে সেবাখাতের মধ্যে ভূমি অফিস, এসিল্যান্ড অফিস, সাব রেজিস্ট্রি অফিস ভূমি অধিদপ্তর প্রত্যেকটি অফিস দুর্নীতির শীর্ষে ছিল। আমরা টিআইবির পক্ষ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে আবার জরিপ করেছি। যা এ মাসে বা আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশ করব। সেখানেও সেই জরিপে দেখা যায়, সেবা খাতের মধ্যে ভূমি সংক্রান্ত সকল অফিসে পদে পদে মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে।’
বিভিন্ন সেবাখাত নিয়ে ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট প্রকাশিত টিআইবি প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এনটিভি। ওই প্রতিবেদনে ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্য তুলে ধরা হয়। সেখানে ভূমি সেবাসহ ১৫টি খাতের ওপর বিশ্লেষণধর্মী ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। জানা যায়, উপজেলা সেটেলমেন্ট অফিসে ৬৮ দশমিক ছয় শতাংশ, উপজেলা ভূমি অফিসে ৬২ দশমিক ছয় শতাংশ, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ৪২ শতাংশ এবং ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ২৭ দশমিক আট শতাংশ দুর্নীতির শিকার।
‘চার বছর আগের এই প্রতিবেদনে উল্লেখিত ভূমি খাতের অনিয়মে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি’ উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘সাব রেজিস্ট্রি অফিস, উপজেলা ভূমি অফিস, এসিল্যান্ড অফিসের প্রত্যেকটিতে সিন্ডিকেট জড়িত। এসব অফিসে অনিয়ম, দুর্নীতি রয়েছে। ফলে মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের ধারণা ছিল, ডিজিটালাইজেশন হলে কিছুটা দুর্নীতি কমবে। কিন্তু, কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন হয়নি। বরং, সেবার পরিবর্তে মানুষের ভোগান্তি আগের মতোই থেকে গেছে।’
টিআইবির ২০১৮ সালের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, নামজারিতে সর্বাধিক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। সেসময় এ খাতে অনিয়ম হতো ৬৫ দশমিক দুই শতাংশ। এ ছাড়া ভূমি জরিপে ৫৯ দশমিক ছয় শতাংশ, ডকুমেন্ট উত্তোলন ও তল্লাশির ক্ষেত্রে ৫২ দশমিক ছয় শতাংশ, হেবা ও দলিল রেজিস্ট্রেশনে ৪২ দশমিক পাঁচ শতাংশ থানা দুর্নীতির শিকার ছিল।