খরচ কমাতে হবে, দুর্নীতির পথ বন্ধ করতে হবে : পরিকল্পনামন্ত্রী
আগামী বছর সারা বিশ্বেই মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ মন্দা মোকাবিলায় বাংলাদেশে প্রস্তুতি কী? কীভাবে মন্দার মোকাবিলা করবে বাংলাদেশ? এ বিষয়ে ডয়চে ভেলের কাছে নিজের মতামত তুলে ধরেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুল মান্নান৷
ডয়চে ভেলে : আগামী বছর বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ আমাদের প্রস্তুতি কেমন?
আব্দুল মান্নান : বিভিন্ন সচেতন মহল, বিশেষ করে অর্থনীতিবিদরা একটা মন্দার আশঙ্কা করছেন৷ মন্দা যখন উন্নত অর্থনীতিতে হবে, তখন আমরা যারা তাদের অধস্তন অর্থনীতি বলতে পারেন; আমরাও তাদের সঙ্গে বিশ্ব বাজারের অংশ৷ আমরাও বিশ্ববাজারে বিক্রি করি, কিনি ইত্যাদি, ইত্যাদি৷ সুতরাং ওখানে মন্দা হলে আমাদের এখানেও হয়ে যাবে৷ এটা এড়ানোর কোনো পথ নেই৷ আমরা কী ব্যবস্থা নিতে পারি? যেহেতু এটা বিশ্বজনীন সমস্যা, বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতি যেমন চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জার্মানি তারা ঘরে ফেরার জন্য যে সকল ব্যবস্থা নেবে এবং তারা মন্দা থেকে বের হওয়ার যদি কোন পথ পায়, আমরাও পাব বলে আশা করি৷ বিশ্ব অর্থনীতিকে প্রভাবিত করার মতো অবস্থা আমাদের নেই৷ আমরা যদি কৃষিতে উৎপাদন ঠিক রাখতে পারি, স্থানীয় বাজারে যদি চালের সরবরাহ ঠিক রাখতে পারি, তাহলে অনেকটা প্রশমিত হবে৷ মানুষের কল্যাণের জন্য আমাদের যে উন্নয়ন প্রকল্প সেগুলো বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে৷ ঋণের বাজারও সংকুচিত হবে৷ বিশ্বব্যাংক বা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংককে যারা তহবিল দেয় ওই বড় অর্থনীতিগুলো তারা মন্দায় পড়ে গেলে টাইট হয়ে যাবে৷ তারা টাইট হয়ে গেলে এসব সংস্থার ঋণ দেওয়ার শক্তি কমে যাবে৷ তখন আমরা হাত বাড়ালেই ঋণ পাব না৷ যদিও এখানে কথা আছে, ঋণ দিলেই যে আমরা নেব এমন কোনো কথা নেই৷ বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার মধ্যে পড়লে আমাদের দুটি কৌশল নিতে হবে৷ একটা হল অভ্যন্তরীণ বাজার অর্থাৎ কৃষি, কায়িক পরিশ্রম যারা করে অনানুষ্ঠানিকখাতে তাদের সহায়তা দিয়ে চাঙা রাখতে হবে৷ সারা বিশ্বের তাপ আমাদের গায়ে লাগবেই৷ সেটা আমাদের কৌশলের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে৷ আরেকটা হল ব্যয় সাশ্রয়ী হতে হবে৷ অভিলাষী পরিকল্পনা কাটছাঁট করতে হবে৷ কোমরে বেল্ট বাঁধতে হবে৷ এসবই আমাদের করণীয় হতে পারে৷
‘খরচ কমাতে হবে সরকারি, ব্যক্তিগত, পারিবারিক পর্যায়ে’
বাংলাদেশের কোন খাতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়তে পারে?
মন্দা হলে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়তে পারে এক্সপোর্ট খাতে৷ আমরা তো মাঝারি যেসব সামগ্রী যেমন- কাপড়, সবজি, মাছ এগুলো আমরা রপ্তানি করি৷ পশ্চিমা দেশগুলোতে মন্দা হলে এসবের ডিমান্ড কমে যাবে৷ ডিমান্ড কমে গেলে আমরা কোথায় পাঠাব? সুতরাং আমাদের এক্সপোর্টের ওপর একটা আঘাত আসবে৷ সেটা হলো আমাদের প্রাথমিক ও প্রধান আঘাত৷ আরেকটা হল, পশ্চিমা মন্দা মধ্যপ্রাচ্যে আসবেই৷ ফলে সেখানে আমাদের যেসব শ্রমিক শারীরিক পরিশ্রম করে কাজ করে সেসব শ্রমিকের ডিমান্ডও কমে যাবে৷ ফলে তাদের আয়ও কমে যাবে৷ তারা দেশে কম টাকা পাঠাবে৷ ফলে এখানেও একটা আঘাত আসবে৷ এসব কারণে আমাদের সরকারি ব্যয় অনেক কমাতে হবে৷ বেসরকারি খাতেও সংশ্লিষ্টরা ব্যয় পুনর্বিন্যাস করবেন৷ যাতে কম জরুরি ব্যয় পরে করা যায়৷ মন্দা তো আর চিরস্থায়ী হবে না, মন্দারও একটা সময় আছে৷ কিছুদিন পর মন্দাও উঠে দাঁড়াবে৷ তখন আমরাও উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ পাব৷ সারা বিশ্বের অর্থনীতি এখন একটা চেইনের মধ্যে আছে৷ আগের মতো বিচ্ছিন্ন নই আমরা৷ এর ভালো দিক হলো, সারা বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও সামনের দিকে এগুতে পারি৷ আর মন্দ দিক হলো, ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য আমরা দায়ী নই, কোভিডের জন্য আমরা দায়ী নই, পশ্চিমাদের ভূরাজনৈতিক কৌশলের কারণে আমরা দায়ী নই, অথচ আমরা এর শিকার৷ এর থেকে বের হওয়ার পথ আমাদের সীমিত৷ ফলে আমি যদি আমার কোমরে বেল্ট বাঁধি, কেউ তো মানা করতে পারবে না৷ আমি যদি তিন তরকারি দিয়ে ভাত না খেয়ে দুই তরকারি দিয়ে ভাত খাই, তাও তো সাশ্রয় হবে৷ কিছু কিছু নির্মাণ কাজ যেগুলো দুই বছর পরে করলেও সমস্যা নেই সেগুলো তখন করব না৷ খুব জরুরি যেগুলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি এগুলো ধরে রেখে বাকিগুলোতে কাটছাঁট করি তাহলে আমার মনে হয় আমরাও পার হতে পারব৷ কিছু বাধা তো আসবেই৷
রিজার্ভে কেমন টান পড়তে পারে আমাদের?
রিজার্ভে তো অবশ্যই টান পড়বে৷ রেমিটেন্স যদি কমে যায়, এক্সপোর্ট কমে যায়- এই দুই খাতেই তো বড় বিজার্ভ গড়ে ওঠে৷ বিদেশি সহায়তায় যে ঋণ সেটাতেও রিজার্ভে টান পড়তে পারে৷ কিন্তু তখন আমরা তো ঋণ কম করব৷ তখন তারা ঋণ দেবেও কম আর আমরা নেবও কম৷ মন্দা সর্বত্রই হবে৷ ফলে এ কারণে বলছি, আমাদের সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে৷
বর্তমানে রিজার্ভ সংকট আমরা কতটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি?
কোনো সংকট এখনও হয়নি৷ এখনও সম্মানজনক পর্যায়ে আছে৷ এখনও ৩০-৩৫ বিলিয়ন ডলার আছে৷ সুতারাং এটা যথেষ্ট বলেই আশা করি৷ তবে হ্যাঁ, চাপের মধ্যে আছে৷ সত্যি যদি পশ্চিমা জগতে মন্দা হয়, তাহলে আমাদের চাপ বাড়বে৷ আমরা সংকটে না পড়লেও সংকটের কাছাকাছি চলে যাব৷
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মন্দার আশঙ্কা করছেন৷ আমরা কতটা প্রস্তুত?
আমি তো এতক্ষণ প্রস্তুতির কথাই বললাম৷ প্রধান প্রস্তুতি হলো, নিজের ঘর ঘোছানো৷ ব্যয়গুলোকে পুনর্বিন্যাস করা৷ যেসব ব্যয় দুদিন পরে করলেও হয়, সেই ব্যয়গুলোকে কাটছাঁট করে চলা৷ জরুরি ব্যয় আমরা কমাব না৷ এতে বাজারের ক্ষতি হবে৷ তাতে মানুষের আয় আরও কমে যাবে৷ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি আমরা আগের পর্যায়েই ধরে রাখব৷ কল্যাণমূলক ব্যয় অবশ্যই করতে হবে৷
দুর্নীতি বন্ধ করা গেলে কী আমাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে?
দুর্নীতি বন্ধের জন্য আইনকানুন শক্তিশালী করতে হবে৷ সেটা আমরা করতেও চাচ্ছি৷ এটা আইনের ব্যাপার৷ সরকার তো আইন প্রয়োগ করে না৷ সরকার দুর্নীতির মামলা দিয়ে ধরে আদালতে নিয়ে যাবে৷ সেখানে সিদ্ধান্ত কী হবে সেটা আদালত বলতে পারবে৷ আমরা আরও তৎপর হবো৷ দুর্নীতির বিষয় আরও সীমিত করব৷ প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াব৷ যারা এসব কাজে আছে, তাদের ওপর নজরদারি বাড়াব৷
আগের মন্দা থেকে কী আমরা কোনো শিক্ষা নিতে পেরেছি?
শিক্ষা অনেক নিয়েছি, ব্যবস্থাও নিচ্ছি, আরও নিব৷
মূল্যস্ফীতি কী অনেক বেড়ে যেতে পারে?
মূল্যস্ফীতি কমছে৷ এই মাসে কমেছে, আগামী মাসে আরও কমবে৷ মন্দাতে কিন্তু অনেক সময় মূল্য পড়েও যায়৷ বাজারে যদি কেউ মাল না কেনে তাহলে মূল্যস্ফীতি কোথা থেকে আসবে? মানুষের কষ্ট হবে৷ এমনও হতে পারে কম দামেও মানুষ পণ্য কিনতে পারবে না৷ এখনকার ৫০ টাকার চাল যদি ২০ টাকাও হয়ে যায় কিন্তু আমার যদি কোন উপার্জন না থাকে, তাহলে আমি কিনব কীভাবে?
সাধারণ মানুষকে টিকিয়ে রাখতে কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত?
খরচ কমাতে হবে সরকারিভাবে, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে৷ কম প্রয়োজনীয় খরচ কমাতে হবে৷ দুর্নীতির পথগুলোকে আরও বেশি করে বন্ধ করতে হবে৷ কেনাকাটাতে সাবধান হতে হবে৷ যেটা দরকার সেটাই কিনব৷ অহেতুক কিনে মাল ঘরে ধরে রাখব না৷ একই জিনিস কম দামে কোথায় পাওয়া যায়, সেটা খুঁজতে হবে৷ এসব বিষয়ে সাবধান হতে হবে৷