খুলনা থেকে নিখোঁজ রহিমা যেভাবে উদ্ধার হলেন
খুলনার দৌলতপুর থেকে নিখোঁজ হওয়া গৃহবধূ রহিমা বেগম উদ্ধার হওয়ার ১৫ ঘণ্টা পর মেয়েদের উপস্থিতিতে মুখ খুলেছেন। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) খুলনার পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফেকুর রহমান জানান, মামলার বাদী ভিকটিম আদুরী আক্তারের উপস্থিতিতে আজ রোববার দুপুরে পর রহিমা বেগম প্রথম মুখ খোলেন।
রহিমা বেগম পিবিআইকে জানান, ঘটনার দিন চারজন রুমাল দিয়ে তার নাক চেপে ধরলে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। তাকে বান্দরবান এলাকায় নিয়ে গিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল। গত ১৭ সেপ্টেম্বর অপহরণকারীরা তাকে একটি বাসে উঠিয়ে দিলে তিনি ফরিদপুরে এসে নামেন এবং তার বাড়ির সাবেক ভাড়াটিয়া কুদ্দুসের বাড়িতে আশ্রয় নেন।
আজ বিকেল ৩টার দিকে রহিমা বেগমকে তার মেয়ে ও মামলার বাদীর সঙ্গে আদালতে পাঠানো হয়। বিকেল ৫টা থেকে ৫টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেট মো. আল আমিনের খাস কামড়ায় তিনি ২২ ধারায় ভিকটিম হিসেবে জবানবন্দি দেন। এই সময় বাদী আদুরী আক্তার তার মায়ের সঙ্গে ছিলেন।
ম্যাজিস্ট্রেটের খাস কামরা থেকে বের হয়ে আদুরী আক্তার জানান পিবিআইকে যা বলেছেন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনেও একই কথা বলেছেন তার মা রহিমা বেগম।
ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন খুলনার মরিয়ম মান্নানের মা রহিমা বেগম (৫২)। ওই বাড়ির লোকজনকে রহিমা বলেছিলেন, ছেলেমেয়েদের ওপর রাগ করে তিনি ঘর ছেড়েছেন। তিনি আর বাড়ি ফিরতে চান না। প্রতিবেশিদের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধের কথাও বলেছিলেন তিনি।
কুদ্দুস মোল্লা (৭০) কর্মসূত্রে দীর্ঘদিন খুলনায় বসবাস করেছেন। তিনি খুলনার সোনালী জুট মিলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। তখন রহিমা বেগমের বাড়িতে ভাড়া ছিলেন। বছর দশেক আগে ওই জুটমিল বন্ধ হওয়ার পর কুদ্দুস নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। এই বাড়ি থেকেই গতকাল শনিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে খুলনা মহানগর পুলিশের একটি দল রহিমা বেগমকে উদ্ধার করে।
গতকাল শনিবার সকালে সৈয়দপুর গ্রামে কুদ্দুস মোল্লার বাড়ির লোকজন ও আশপাশের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৭ সেপ্টেম্বর বিকেল ৪টা বা সাড়ে ৪টার দিকে একটি বাসে করে রহিমা বেগম সৈয়দপুর বাসস্ট্যান্ডে নামেন। তখন তাঁর হাতে একটি ব্যাগ ছিল। তিনি এসে ওই বাজারের মুদিদোকানি ইউনুস বিশ্বাসের কাছে মোতালেব মুসল্লির (কুদ্দুস মোল্লার বাবা) বাড়ি কোথায় জানতে চান। তখন ইউনুস বিশ্বাস তাঁর পরিচয় জানতে চান। তখন তিনি বরিশাল থেকে এসেছেন এবং কুদ্দুস মোল্লার স্ত্রী হীরার চাচাতো বোন বলে পরিচয় দেন। তখন ইউনুস এক শিশুকে সঙ্গে দিয়ে তাঁকে কুদ্দুস মোল্লার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।
কুদ্দুস মোল্লার জামাতা নূর মোহাম্মদ বলেন, রহিমা বেগম কেন বাড়িতে এসেছেন, তা তিনি তাঁর শাশুড়ি হীরার কাছে জানতে চান। তার শাশুড়ি তাকে জানান, তাঁরা যখন খুলনায় ছিলেন তখন রহিমার সঙ্গে তাঁদের পরিচয় হয়। সেই সূত্রে তিনি বেড়াতে এসেছেন।
কুদ্দুসের মেয়ে সুমাইয়া বেগম বলেন, রহিমা বাড়িতে স্বাভাবিকভাবেই দিনগুলো কাটিয়েছেন। তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন এবং সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন। আশপাশের বাড়িতে বেড়াতেও গেছেন। তবে তাঁর চোখের সমস্যা ছিল, চোখ দিয়ে পানি পড়ত। এ জন্য বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে চিকিৎসক দেখানো হয়।
সুমাইয়া আরও বলেন, রহিমা বেগম তাঁকে বলেছেন—জমি নিয়ে প্রতিবেশির সঙ্গে তাঁদের গণ্ডগোল হয়েছে, ঝামেলা চলছে। এই ঝামেলার জন্য তাঁকে মারধর করা হয়েছে। তাই তিনি বাড়ি থেকে চলে এসেছেন। যদিও তাঁর শরীরে কোনো আঘাত পাওয়া যায়নি। তবে তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল ছিলেন।
কুদ্দুস মোল্লার ভাগনে মোহাম্মদ জয়নাল বলেন, গত শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক এবং বিভিন্ন অনলাইনে তিনি রহিমা বেগমের ছবি দেখতে পান। ওই ছবিটি দেখানো হলে রহিমা বেগম ছবিটা নিজের বলে শনাক্ত করেন। এরপর তিনি লোকজনকে বলেন, তাঁর ছেলেমেয়ে তাঁকে কেউ পছন্দ করে না। তিনি বাড়িতে ফিরে যাবেন না। তিনি বাড়ি গেলে তাঁকে মেরে ফেলা হবে।
মোহাম্মদ জয়নাল বলেন, রহিমা তাঁকে জানিয়েছেন, তিনি মৃত স্বামী মান্নানের কাছ থেকে দুই কাঠা জমি পেয়েছেন। তাঁর ছেলেমেয়েরা এই জমি বিক্রির জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। ছেলেমেয়েরা জমি বিক্রি করে টাকা নিয়ে অন্যত্র চলে যেতে চান। কিন্তু তিনি তাতে রাজি হননি। তিনি রাগ করে চলে এসেছেন।
জয়নাল আরও জানান, এ ঘটনা জানার পর কুদ্দুসের ছেলে আল আমিন ফেসবুকে রহিমার মেয়ে মরিয়ম মান্নানের ফেসবুক আইডিতে এ বিষয়ে কমেন্ট করেছিলেন। কিন্তু তিনি কোনো উত্তর দেননি। এ ছাড়া ফেসবুক ঘাঁটাঘাঁটি করে তিনি রহিমা বেগমের ছেলে মিরাজের নম্বর পেয়েছিলেন। সেই নম্বরে ফোন দেওয়ার পর ফোনটি এক নারী ধরেন। ওই নারী বলেন, ‘এই নম্বরে আর ফোন দেবেন না।’ এ কথা বলে তিনি ফোনটি কেটে দেন। এরপর রহিমা বেগমের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করা হয়নি।
গত শুক্রবার রহিমা বেগমের ছবি দেখার পর শনিবার সকালে স্থানীয় ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. মোশারফ মোল্লাকে বিষয়টি জানান কুদ্দুসের ভাগনে জয়নাল ও জামাতা নূর মোহাম্মদ। মোশারফ মোল্লা খুলনা সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের সহযোগিতায় বিষয়টি খুলনা পুলিশকে জানান। মোশারফ মোল্লার সঙ্গে কথা বলে পুলিশ নিশ্চিত হয় রহিমা বেগম সৈয়দপুর গ্রামে আছেন। পুলিশ রহিমা বেগমকে নজরে রাখতে বলেন। যেকোনো মুহূর্তে তারা সৈয়দপুর আসবে।
জয়নাল বলেন, রাত সাড়ে ১০টার দিকে ইউপি সদস্য মোশারফ তাঁকে ফোন করে বলেন খুলনা থেকে লোকজন এসেছে। এরপর খুলনা মহানগর পুলিশের এডিসি আবদুর রহমানের সঙ্গে একজন নারী পুলিশ সদস্যসহ চার-পাঁচজন কুদ্দুস মোল্লার বাড়িতে যান। এডিসি আবদুর রহমান গিয়ে রহিমা বেগমের সামনে দাঁড়ান। আবদুর রহমান তাঁকে বলেন, ‘আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন কী না, আমি আবদুর রহমান।’ এ সময় রহিমা বেগমকে আরও কিছু প্রশ্ন করেন তিনি। তবে কোনো প্রশ্নের উত্তরই রহিমা বেগম দেননি। পুলিশ আসার আগে রহিমা বেগম বাড়ির সবার সঙ্গে গল্প করছিলেন। পুলিশ দেখে তিনি চুপ হয়ে যান।
পরে রহিমা বেগমকে নিয়ে যান পুলিশ সদস্যরা। এ সময় কুদ্দুস মোল্লার স্ত্রী হীরা বেগম (৬০), ছেলে আল আমিন (২৫) ও কুদ্দুসের ভাইয়ের স্ত্রী রাহেলা বেগমকেও (৪৫) নিয়ে যায় পুলিশ।
নূর মোহাম্মদ জানান, রহিমা বেগম প্রথম প্রথম একাই ওই কক্ষে থাকতেন। তবে শুক্রবার রহিমা বেগমের বিষয়টি জানার পর হীরা বেগম তাঁর সঙ্গে থাকতেন।
ইউপি সদস্য মোশারফ হোসেন মোল্লা (৩৫) বলেন, কুদ্দুস মোল্লা সৈয়দপুরে ফিরে এসে স্থানীয় জনতা জুট মিলের শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরিবারটি অত্যন্ত নিরীহ। শুক্রবার রাতে রহিমা বেগমের সঙ্গে কুদ্দুসের স্ত্রী–পুত্রসহ তিনজনকে নিয়ে গেছে পুলিশ। তাঁরা বর্তমানে খুলনায় পুলিশ হেফাজতে আছেন। তিনি এ ব্যাপারে খুলনা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। খুলনা পুলিশ জানিয়েছে, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এবং পরে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হবে।