ধর্মান্ধ, উগ্রপন্থিদের রোষানলের বলি ড. হুমায়ুন আজাদ : আদালতের পর্যবেক্ষণ

Looks like you've blocked notifications!
লেখক ও শিক্ষাবিদ হুমায়ুন আজাদ। ফাইল ছবি

সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির বাইরে গিয়ে সাহিত্য রচনার কারণে কতিপয় ধর্মান্ধ, উগ্রপন্থি লোকদের রোষানলের বলি হতে হয় ড. হুমায়ুন আজাদকে। ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আল-মামুন রায়ের পর্যবেক্ষণে এ কথা বলেন। আজ বুধবার এ মামলার রায়ের আংশিক কপি প্রকাশ হয়েছে। রায়ের কপি থেকে এ বিষয়ে জানা গেছে। 

রায়ে বিচারক পর্যবেক্ষণে আরও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ভাষাবিজ্ঞানী, সমালোচক, কিশোর সাহিত্যিক, গবেষক ও অধ্যাপক। সুনামের সাথে অধ্যাপনা করেছেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাধ্যের সবটুকু দিয়ে অকাতরে জ্ঞান বিতরণ করেছেন প্রিয়তম ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে। জীবদ্দশায় নানাবিধ প্রতিকূলতা পাশ কাটিয়ে প্রচলিত রীতিনীতির বাইরে গিয়ে রচনা করেছেন অসংখ্য গ্রন্থ; যা বাংলা সাহিত্যভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। জায়গা করে নিয়েছিলেন সাহিত্য প্রেমীদের মনের মণিকাঠায়। এমতাবস্থায়, সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির বাইরে গিয়ে সাহিত্য রচনার কারণে কতিপয় ধর্মান্ধ, উগ্রপন্থি লোকদের রোষানলের বলি হতে হয় ড. হুমায়ুন আজাদকে।

বিচারক আরও বলেন, ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বের হয়ে বাসায় ফেরার পথে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সামনে আসামি মিজানুর রহমান, আনোয়ারুল আলম, সালেহীন ও নূর মোহাম্মদ রাতের অন্ধকারে চাপাতি, বোমাসহ ড. হুমায়ুন আজাদের ওপর আক্রমণ করেন। তার ওপর জেএমবির সদস্যদের এ আক্রমণ ও পরে মৃত্যুর ঘটনায় বহির্বিশ্বে শান্তিপ্রিয় ও ধর্ম নিরপেক্ষ দেশের সুনাম বহুলাংশে ক্ষুণ্ন করেছে। মামলার আসামিরা জেএমবির সক্রিয় সদস্য হিসেবে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন, যা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল।

গত ১৩ এপ্রিল ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আল-মামুন এ মামলায় জেএমবির চার সদস্যের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- জেএমবির শুরা সদস্য মিজানুর রহমান ওরফে মিনহাজ ওরফে শফিক, আনোয়ার আলম ওরফে ভাগিনা শহিদ, সালেহীন ওরফে সালাহউদ্দিন ও নূর মোহাম্মদ ওরফে সাবু।

২০১২ সালের ৩০ এপ্রিল সিআইডির পরিদর্শক লুৎফর রহমান পাঁচ আসামিকে অভিযুক্ত করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এর আগে এ মামলাটি ‘হত্যাচেষ্টা মামলা’ হিসেবে তদন্ত করেন তদন্ত কর্মকর্তা। কিন্তু হামলার কিছু দিন পর জার্মানিতে মারা যান হুমায়ুন আজাদ। তার পরই ‘হত্যা মামলা’ হিসেবে এর অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

অভিযোগপত্রের আসামিরা হলেন জেএমবির শুরা সদস্য মিজানুর রহমান ওরফে মিনহাজ ওরফে শফিক, আনোয়ার আলম ওরফে ভাগ্নে শহিদ, নুর মোহাম্মদ ওরফে সাবু, সালেহীন ওরফে সালাহউদ্দিন ও হাফিজ মাহমুদ।

অভিযোপত্র থেকে বাদ যাওয়া অপর চার আসামি হলেন আবু আব্বাস ভুইঞা, গোলাম মোস্তফা ওরফে মোস্তফা মাহমুদ, আব্দুল খালেক গবা ওরফে টাইগার ও শফিক উল্লাহ সাদ।

এ মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়ার আগেই অন্য একটি মামলায় ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায় আসামি শায়খ আবদুর রহমান, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আওয়াল, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই এবং খালেদ সাইফুল্লাহর নামও মামলার অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়।

এ আসামিদের ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ ঝালকাঠির একটি বিচারক হত্যা মামলায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। অভিযোগ প্রমাণিত হলেও অভিযোগপত্র দাখিলের আগেই মারা যাওয়ায় জনৈক নুরুল্লাহ ওরফে হাফিজকেও মামলার অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

নথি থেকে জানা যায়, ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সামনে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন লেখক হুমায়ুন আজাদ। দুর্বৃত্তরা এ সময় তাঁকে চাপাতি ও কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে মাথায়, মুখে ও ঘাড়ের ওপর মারাত্মক জখম করে। ঘটনার পরদিন হুমায়ুন আজাদের ভাই মঞ্জুর কবির রমনা থানায় একটি হত্যা চেষ্টা মামলা দায়ের করেন।

এর আগে ২০০৭ সালের ১৪ নভেম্বর জেএমবি নেতা শায়খ রহমান, আতাউর রহমান সানি, নুর মোহাম্মাদ সাবু ওরফে শামীম, মিনহাজ ওরফে শফিক, আনোয়ার ওরফে ভাগ্নে শহিদকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করেছিল পুলিশ।

সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে হুমায়ুন আজাদের ভাই ও এই মামলার বাদী মো. মঞ্জুর কবির ২০০৯ সালের ৬ অক্টোবর মামলাটির বর্ধিত তদন্তের আবেদন করলে ২০ অক্টোবর আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন। 

২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি হামলার শিকার হওয়ার পর ২২ দিন সিএমএইচ হাসপাতালে এবং ৪৮ দিন ব্যাংককে চিকিৎসারত ছিলেন। ২০০৪ সালের ৭ আগস্ট জার্মানি যান তিনি। ২০০৪ সালের ১২ আগস্ট ড. হুমায়ুন আজাদ জার্মানির মিউনিখে মারা যান।

বিভিন্ন সময় মামলাটি তদন্ত করেছেন রমনা থানার উপপরিদর্শক মাহবুবুর রহমান, সিআইডির পরিদর্শক কাজী আবদুল মালেক, মোস্তাফিজুর রহমান ও লুৎফর রহমান। ২০১০ সালের ১৮ অক্টোবর আসামি আনোয়ার আলম ওরফে ভাগ্নে শহিদ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এ মামলায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে পাঁচ দফায় ১২ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তবে শেষ পর্যন্ত এ মামলার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় অব্যাহতি দেওয়া হয়।