ফুলবাড়ী ট্র্যাজেডির ১৬ বছর
দিনাজপুরের ফুলবাড়ী ট্র্যাজেডির ১৬ বছর আজ শুক্রবার। জাতীয় সম্পদ রক্ষা, বহুজাতিক কোম্পানি এশিয়া এনার্জিকে ফুলবাড়ী থেকে প্রত্যাহার এবং উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের প্রতিবাদে ২০০৬ সালের এই দিনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান তিন জন। এ ছাড়া আহত হয় প্রায় আড়াই শতাধিক প্রতিবাদী মানুষ। ইতিহাসের এ দিনটিকে বর্বরোচিত দিন হিসেবে গণ্য করা হয়।
দিবসটি যথাযথভাবে পালনের লক্ষ্যে তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, ফুলবাড়ীর বিভিন্ন অরাজনৈতিক পেশাজীবী সংগঠন ও সম্মিলিত ফুলবাড়ীবাসী পৃথকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে—গণজমায়েত, কালো ব্যাজ ধারণ, শোক র্যালি, স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পমাল্য অর্পণ, আলোচনা সভা, প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারক লিপি প্রদান, মিলাদ মাহফিল ও প্রার্থনা।
২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট নিজেদের অস্তিত্ব ও স্থায়ী সম্পদ রক্ষার স্বার্থে ফুলবাড়ীসহ আশপাশের কয়েকটি উপজেলার মানুষ ফুলবাড়ী কয়লা খনি বিরোধী আন্দোলনের যে ডাক দিয়েছিলেন, সে কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে আমিন, সালেকিন ও তরিকুল প্রাণ হারান। একই সঙ্গে কয়েকজন চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায় এবং আহত হয় শত শত মানুষ। আহতদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ বাবুল রায়ের শরীরের বেশিরভাগ অংশ বর্তমানে অবশ। পঙ্গুত্ব বরণ করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিনি। দেশের সম্পদ রক্ষার আন্দোলন করতে গিয়ে ঘরের কোনের ছোট্ট বিছানাই এখন তাঁর একমাত্র সঙ্গী। তাঁর দুঃখ—এত কিছুর পরেও ফুলবাড়ীর আপামর জনতার সঙ্গে তৎকালীন সরকারের সে চুক্তি আজও বাস্তবায়ন হয়নি। সেসময় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের প্রতিবাদে গণবিদ্রোহে ফুলবাড়ীতে বিপ্লব সাধিত হলেও আজও থামেনি উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর স্বজন হারানোর কান্না। এখনও বইছে সে শোকের আবহ। এরই ধারাবাহিকতায় দিবসটি স্মরণে প্রতি বছর ফুলবাড়ীর মানুষ ব্যাপকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে।
ফুলবাড়ীর মানুষ মনে করেন, সেদিন যে গণবিজয় অর্জিত হয়েছিল, তা শুধু ফুলবাড়ীবাসীর নয়, সে বিজয় সারা দেশবাসীর জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। ওই এলাকায় স্থায়ী সম্পদ ধ্বংস করে এবং লাখও মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন করে কয়লা খনি প্রকল্প চালু হলে পথে বসতে হতো হাজারও পরিবারকে। কারণ, এ এলাকার কৃষিজীবি মানুষ তিন ফসলি এসব জমিতে ধান, চাল, রবি শস্য উৎপাদনে অভিজ্ঞ ও অভ্যস্ত। এর ফলে মাঠে-ঘাটে খেটে খাওয়া এসব মানুষ ক্ষতিপূরণের অর্থ দিয়ে তা ভাঙিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকলে এক সময় তাদের পথে বসতে হতো। অর্থ থাকলেই তা দিয়ে সম্পদ কেনা কিংবা ব্যবসা বাণিজ্য করা সহজে সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই, মানুষের মনে আশঙ্কা ছিল ফুলবাড়ী কয়লা খনি বাস্তবায়ন হলে কৃষক হারাবে তিন ফসলি কৃষি জমি, ব্যবসায়ী হারাবে দীর্ঘ দিনের ব্যবসা-বাণিজ্য, শ্রমিক হয়ে পড়বে বেকার ও কর্মহীন, ছাত্র-ছাত্রী হারাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এখানকার সাধারণ মানুষ হবে দিশেহারা ও উদ্বাস্তু। আর তাই, ফুলবাড়ীবাসীর প্রাণের দাবি ‘স্থায়ী সম্পদ ধ্বংস করে ফুলবাড়ীতে কয়লা খনি চাই না’ শ্লোগানকে সামনে রেখে বিভিন্ন অরাজনৈতিক পেশাজীবী সংগঠন ও ফুলবাড়ীবাসী সম্মিলিতভাবে ফুলবাড়ী শোক দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের সিদ্ধাস্ত নিয়েছে।
দেড় যুগ আগে যে ছয় দফা চুক্তি হয়েছিল, তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন বিষয়ে ফুলবাড়ী সম্মিলিত পেশাজীবি সংগঠনের আহ্বায়ক ও সাবেক পৌর মেয়র মুর্তুজা সরকার মানিক বলেন, ‘বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ২০০৬ সালে বিরোধী দলীয় নেতা থাকাকালে ফুলবাড়ীতে এসে ফুলবাড়ীবাসীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি যদি ক্ষমতায় যান, তাহলে ফুলবাড়ীবাসীর সঙ্গে সম্পাদিত ছয় দফা চুক্তি বাস্তবায়ন করবেন।’ সে ছয় দফা চুক্তি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চান মানিক।
এদিকে, তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ফুলবাড়ী শাখার আহ্বায়ক সৈয়দ সাইফুল ইসলাম জুয়েল বলেন, ‘বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় ২০০৬ সালে ফুলবাড়ীতে এসে ফুলবাড়ীর বীর জনতাকে স্যালুট জানিয়ে, ক্ষমতায় গিয়ে ফুলবাড়ীবাসীর সঙ্গে সম্পাদিত ছয় দফা চুক্তি বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু, ক্ষমতার মসনদে বসে আজও সে প্রতিশ্রুতির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করেননি। সে কারণে আবারও এশিয়া এনার্জির কমিশনভোগী দালালরা নানাভাবে ফুলবাড়ীবাসীকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করছে।’
সৈয়দ সাইফুল ইসলাম আইন করে ফুলবাড়ীবাসীর ছয় দফা চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে এশিয়া এনার্জির দালালদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। একই দাবি জানান তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির অন্যতম সদস্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বাবলু।