বছরটি যেভাবে কাটাল আওয়ামী লীগ
করোনা সংক্রমণের কারণে মিছিল-মিটিং তুলনামূলক কম থাকলেও বছরজুড়ে ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম ছিল চোখে পড়ার মতো। দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোটভাই মির্জা কাদেরের বিভিন্ন মন্তব্য, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়ে বক্তব্য উত্তেজনা ছিল। বছরের শেষদিকে এসে আলোচনা-সমালোচনায় তুঙ্গে ছিল ক্ষমতাসীন দলটি।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন
বছরের শুরুতেই যাত্রাবাড়ীর ধোলাইপাড় এলাকায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনকে কেন্দ্র করে ইসলামী দলগুলোর বাধার মুখে পড়ে আওয়ামী লীগ। তবে রাজনৈতিকভাবে তা মোকাবিলা করতে সক্ষম হয় দলটি।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন
মার্চে ব্যাপক উৎসবের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয় মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। ১০ দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানে যোগ দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ কয়েকটি দেশের সরকারপ্রধান ও মন্ত্রী। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এ অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির আগমন উপলক্ষে হেফাজতে ইসলাম দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। এ ইস্যুতে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনগুলোও পাল্টা-সমাবেশ ও মিছিল করে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করে।
হেফাজত ইস্যুর পাশাপাশি রাজনীতিতে আলোচনায় আসে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোটভাই মির্জা কাদের। তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য ঘিরে আলোচনা-সমালোচনা হয়। বছরের প্রায় পুরোটা সময়জুড়েই তিনি আলোচনায় ছিলেন বিভিন্ন বক্তব্য ও বিবৃতি দিয়ে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন
স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ বছরজুড়েই ছিল তৎপর। প্রার্থী বাছাই, দলীয় প্রতীক প্রদান ও বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ নিয়ে সক্রিয় ছিলেন দলটি কেন্দ্রীয় নেতারা। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের পাশাপাশি মূল দলও নির্বাচনকে ঘিরে সক্রিয় ছিল। ছয় দফায় ইউনিয়ন পরিষদ, বেশ কয়েকটি পৌরসভা ও উপজেলাসহ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও একক প্রর্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
তৃণমূল থেকে সুপারিশের ভিত্তিতে এসব মনোনয়ন দিলেও কেন্দ্রে এদের বিরুদ্ধে অভিযেগের পাহাড় জমা পড়েছে। তৃণমূলে প্রার্থী বাছাইয়ে আত্মীয়করণ, নিজস্ব বলয় তৈরি আর প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের বিষয়টি চিন্তা করে ত্যাগীদের মূল্যায়ন না করারও অভিযোগ উঠে। এসব অভিযোগের মূলে রয়েছেন জেলার নেতারা। এসব কারণে অনেকে বিদ্রোহী প্রার্থীও হয়েছেন বিভিন্ন জায়গায়। বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের মধ্যে সহিংসতার ঘটনাও ঘটে। এই নিয়ে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী বৈঠকেও আলোচনা হয়। তবে স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিগত কয়েক বছরের ভোটারের আকাল কেটে যাওয়ার লক্ষণ দেখা গেছে।
সাংগঠনিক কার্যক্রম
বছরের শুরুতে করোনার কারণে তেমন কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম চোখে না পড়লেও শেষদিকে ফিরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে দলটি। সব সাংগঠনিক বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সম্মেলন সম্পন্ন করার তাগিদ দেওয়া হয়। করোনার কারণে অনেক স্থানে সম্মেলন না হলেও কোথাও কোথাও ঝুঁকি নিয়ে তা সম্পন্ন হয়েছে। বছরজুড়েই ধীরগতিতে সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা সম্মেলন আর বর্ধিত সভা করেছেন। এখনো অনেক জেলা-উপজেলা ও মহানগরের সম্মেলন বাকি রয়েছে।
আলোচিত কাদের মির্জা
নোয়াখালী-৪ (সদর ও সুবর্ণচর) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরীর এক বক্তব্যের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোটভাই কাদের মির্জা প্রতিবাদ জানান। তারপর থেকে একের পর এক বক্তব্য দিয়ে বছরজুড়ে আলোচনা আর সমালোচনায় ছিলেন তিনি। নোয়াখালীর জেলা রাজনীতি নিয়ে কেন্দ্রীয় পর্যায়েও নাড়া দিয়েছিলেন তিনি। পরে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে কিছুটা নমনীয় হন তিনি। তবে এখনো মাঝে মধ্যে সমালোচনা করেন দল ও সরকারের। বড় ভাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে বলতেও পিছপা হন না তিনি।
মেয়র জাহাঙ্গীরের বিদায়
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে কটূক্তি করে গাজীপুর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের বক্তব্য সংবলিত একটি ভিডিও গত অক্টোবরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এতে দলের ভেতরে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। মেয়রের পদত্যাগ ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে জাহাঙ্গীরকে বহিষ্কারের দাবিতে গাজীপুর মহানগরীর কয়েকটি স্থানে বিক্ষোভ করেন দলীয় নেতাকর্মীরা। পরে গত ৩ অক্টোবর দলের স্বার্থ পরিপন্থি কর্মকাণ্ড ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে জাহাঙ্গীর আলমকে শোকজ করে আওয়ামী লীগ। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সই করা শোকজ নোটিশে ১৫ দিনের মধ্যে জাহাঙ্গীরকে এর জবাব দিতে বলা হয়। তবে নির্ধারিত সময়ের আগেই শোকজের জবাব দিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চান গাজীপুরের মেয়র। তবে মাফ পাননি তিনি। দলে কার্যনিবাহী কমিটির বৈঠকে তাকে দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে।
আলোচনায় হেলেনা জাহাঙ্গীর
চলতি বছরে ফেসবুকে নেতা বানানোর ঘোষণা দিয়ে ছবি পোস্ট করে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে সংগঠনটির জেলা, উপজেলা ও বিদেশি শাখায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিয়োগ দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। কথিত এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে হেলেনা জাহাঙ্গীর ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মাহবুব মনিরের নাম উল্লেখ করা হয়। তারপর আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্যপদ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরে হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গুলশানের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ডা. মুরাদকে নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতি
বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কিত বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডের কারণে সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান সংবাদের শিরোনাম হয়েছিলেন। চলতি বছরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিমন্ত্রীর কিছু অডিও-ভিডিও ছড়িয়ে পড়ায় দেশজুড়ে নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় ওঠে। এতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকার। বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলতে না পারলেও সারা দেশে দলের নেতাকর্মীরা তার ওপর বিরক্ত এবং ক্ষুব্ধ হয়। এ ঘটনায় বিএনপিসহ বিভিন্ন নারী সংগঠনও তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তারা ডা. মুরাদের পদত্যাগ দাবি করেন। বিএনপির শীর্ষনেতার পরিবারকে নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্যের পাশাপাশি চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির সঙ্গে ডা. মুরাদ হাসানের টেলিফোনে কথোপকথনের একটি অডিও ভাইরাল হয়। কয়েকদিন আগে ইউটিউবে প্রকাশিত একটি সাক্ষাত্কারে বিএনপির শীর্ষনেতা তারেক রহমানের মেয়েকে নিয়ে অশালীন বক্তব্য দেন তিনি। ডা. মুরাদ হাসানের আপত্তিকর বক্তব্য ও অডিও-ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার ঘটনায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ নির্দেশনার পরই পদত্যাগ করেন ডা. মুরাদ হাসান। যদিও কোনো দেশে জায়গা না পেয়ে তিনি ফের দেশেই ফিরে আসেন।
মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের সমাপ্তি
চলতি বছর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছে আওয়ামী লীগ। গত বছর অনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলেও এই বছরই বেশি অনুষ্ঠান করেছে ক্ষমতাসীন দলটি। গত ১৬ ডিসেম্বর মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের সমাপনী অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যোগ দেন। তিনি ছাড়াও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপতি ও সরকারপ্রধান মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
মুজিববর্ষ উদযাপন করে দেশের বাইরেও সুনাম কুড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পুঁথি পাঠের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও দর্শন এবং কর্মকাণ্ড শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্যও তুলে ধরা হয়। নাচ, গান, কবিতা, মঞ্চনাটক ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কবিতা ও গানে গ্রামবাংলার প্রকৃতি এবং জনজীবন মূর্ত হয়ে ওঠে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড উঠে আসে বিভিন্ন পরিবেশনায়।