বাধার কারণে মাকে দুদিন দেখতে পারেননি বাবা : পাপন
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় মারাত্মক আহত হন আইভি রহমান। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে তিনদিন পর ২৪ আগস্ট শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
আইভি রহমানের ছেলে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি ও কিশোরগঞ্জ-৬ আসনের সংসদ সদস্য নাজমুল হাসান পাপন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঘটনার দিন বিকেলে আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমান তাঁর স্বামী জিল্লুর রহমানের (প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি) সঙ্গে জনসভায় গিয়েছিলেন। সেদিন জিল্লুর রহমান শেখ হাসিনাসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে ট্রাকে ছিলেন। আইভি রহমান মহিলা নেতাকর্মীদের নিয়ে সামনে রাস্তার ওপর বসেছিলেন। গ্রেনেড হামলায় জিল্লুর রহমান সেদিন প্রাণে বেঁচে গেলেও আইভি রহমান মারাত্মক আহত হয়ে ২৪ আগস্ট মারা যান।
নাজমুল হাসান পাপন মায়ের মৃত্যুর বিষয়ে বলেন, ‘ঘটনার দিন খবর পেয়ে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যাই। সেখানে গিয়ে ডাক্তার-নার্স কাউকে দেখতে পাইনি। এ সময় মাকে অন্য হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। তারপর অনেকটা জোর করে মাকে সিএমএইচে নিয়ে গেলাম। সেখানেও চিকিৎসা দিতে বিলম্ব করল। তৎকালীন বিএনপি সরকার আমার বাবা জিল্লুর রহমানকে দুদিন দেখতে দেয়নি মাকে। কতটা নির্মম নিষ্ঠুর আচরণ করেছে তৎকালীন সরকার। মারা যাওয়ার পর লাশ আমার বাবার বাড়ি ভৈরব নিয়ে জানাজা দিতে চাইলাম, এতেও বাধা দেয় সরকার। পরে অনেক নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে বনানী কবরস্থানে মাকে দাফন করলাম।’
নাজমুল হাসান পাপন বলেন, ‘অনেকদিন হয়েছে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় হত্যা মামলার বিচারের রায় হয়েছে। কিন্তু এখনো রায় বাস্তবায়ন হয়নি। আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করেছে। আমি বিচারের রায় বাস্তবায়ন দেখতে চাই। অপরাধীদের শাস্তি হলেই আমার মা কবরে শান্তি পাবেন বলে আমার বিশ্বাস।’
আইভি রহমান ১৯৪৪ সালের ৭ জুলাই ভৈরব শহরের চণ্ডীবের এলাকার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম জেবুন্নেছা আইভি। ১৯৫৮ সালের ২৭ জুন নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় ভৈরবের কৃতী সন্তান (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) জিল্লুর রহমানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এরপর থেকে নামের সঙ্গে ‘রহমান’ যুক্ত হয়। তাঁর বাবা জালাল উদ্দিন ছিলেন তৎকালীন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ। মা হাসিনা বেগম ছিলেন গৃহিণী। আট বোন চার ভাইয়ের মধ্যে আইভি রহমান ছিলেন পঞ্চম।
আইভি রহমান ১৯৬০ সালে বাংলাবাজার স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ১৯৬৯ সালে ইডেন মহিলা কলেজ থেকে স্নাতক এবং ১৯৭২-৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পরীক্ষার্থী ছিলেন।
আইভি রহমান তাঁর জীবনব্যাপী রাজনীতি ও সমাজসেবার মাধ্যমে দেশ ও দেশের মানুষের বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া নারী সমাজের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন। প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি ছিলেন পুরোভাগে। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন ও সংগ্রামকে মহিমান্বিত করে গেছেন। এর বিনিময়ে তিনি কিছু চাননি, সেই আশাও কোনোদিন পোষণ করেননি।
বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য আইভি ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার আহ্বানে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের পর সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে তাঁর ইন্দিরা রোডস্থ বাসভবনে রাইফেল চালানো ও ফার্স্ট এইড বিষয়ক প্রশিক্ষণ নেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেগম বদরুন্নেছা ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য স্থাপিত ক্যাম্পগুলোতে খাবার, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করতেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ ও মনোবল বৃদ্ধির জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রায়ই কথিকা পড়তেন আইভি রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হৃদয়বিদারক ঘটনার পর থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
আইভি রহমান নারী জাগরণে রেখে গেছেন বলিষ্ঠ ভূমিকা। তিনি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৭৬ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত সহসভানেত্রী এবং ২০০৪ সালে সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯৬ সালের আগস্ট থেকে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জাতীয় মহিলা সংস্থার সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
আজ যে বিশাল ১২ তলা মহিলা সংস্থার ভবন, এটি আইভি রহমানের হাতে গড়া। মহিলা জাগরণের যে স্বপ্ন দেখতেন তাঁর ভিত্তি রচনায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ অট্টালিকা নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করেন। তাঁর দায়িত্ব পালনকালেই ছয়তলা পর্যন্ত নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছিল।
এ ছাড়া মহিলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন আইভি রহমান। তিনি ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫, ১৯৮২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তা ছাড়া তিনি ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত ‘এসিড সার্ভাইবার ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
আইভি রহমান ছিলেন অ্যাসোসিয়েট কান্ট্রি ওমেন অব দি ওয়ার্ল্ডের এরিয়া প্রেসিডেন্ট (সেন্ট্রাল অ্যান্ড সাউথ এশিয়া), জাতীয় যৌতুক প্রতিরোধ সমিতি, বাংলাদেশ প্ল্যানিং অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সদস্য ছিলেন।
প্রয়াত আইভি রহমান ১৯৮১ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত সময়ে মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ছিলেন। তা ছাড়া ১৯৭৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা : স্বাধীনতার পদক ২০০৯, এসিড সার্ভাইবার ফাউন্ডেশন পদক ২০০৯, স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীতে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি সংবর্ধনা পদক ১৯৯৬, নাগরিক নাট্যাঙ্গন এবং সোনার বাংলা যুব কল্যাণ পরিষদ ‘মুক্তিযুদ্ধ পদক’, আমেরিকান বায়োগ্রাফি ইনস্টিটিউট থেকে ওমেন অব দ্য ইয়ার ২০০০ নির্বাচিত হন। এ ছাড়া মহিলা সমিতির ‘নারী অধিকার মানব অধিকার’ পদক লাভ করেন আইভি রহমান।
আইভি রহমান স্কুলজীবনে মুকুল ফৌজ, গার্লস গাইডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাজসেবা শুরু করেন। বাংলাদেশ মহিলা সমিতির জন্মলগ্ন থেকে আমৃত্যু তিনি নারীদের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান থাকাকালীন তিনি নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে অনবদ্য ভূমিকা রাখেন। দলমত নির্বিশেষে নারী ও মানবাধিকার সংগঠনের প্রতি ছিল তাঁর অকুণ্ঠ সমর্থন। সর্বক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার আদায়ে তিনি আজীবন ছিলেন একজন নিরলস যোদ্ধা। তিনি ভৈরব জাতীয় মহিলা সংস্থা গঠন করেন। অগ্রণী ভূমিকা রাখেন ভৈরব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠায়।