রাজশাহীতে বেড়েছে করোনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জে অক্সিজেনের জন্য হাহাকার
রাজশাহীতে হঠাৎ বেড়েছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা রোগী বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসক ও নার্সদের। করোনায় সংক্রমিত রোগীদের অক্সিজেন লাগায় এর সরবরাহ নিয়েও উদ্বেগে পড়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, এভাবে রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
এদিকে পাশের জেলা চাঁপানবাবগঞ্জে অক্সিজেনের জন্য চলছে হাহাকার। সরকার দলীয় চিকিৎসকদের পেশাজীবী সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. গোলাম রাব্বানী তাঁর ফেসবুকে অক্সিজেনের হাহাকারের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘এ মুহূর্তে একটা, শুধু একটা জিনিসের খুব প্রয়োজন। তা হলো- অক্সিজেন, অক্সিজেন এবং অক্সিজেন। অক্সিজেনের বড় অভাব। শুধু অভাব নয়, তীব্র হাহাকার।’
চিকিৎসকেরা জানান, ভারতের সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে হাসপাতালের শয্যা ও অক্সিজেনের সংকট। অক্সিজেন প্রয়োজন- এমন অনেক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ না পেয়ে বাড়িতে চলে যাচ্ছে। আবার অনেকে চলে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। দেশে করোনার নতুন হটস্পট হয়ে ওঠা চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে গত ঈদুল ফিতরের পর থেকে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী জানান, মঙ্গলবার সকাল থেকে আগের ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে আরও সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের তিনজন, নাটোরের দুইজন এবং রাজশাহী ও নওগাঁর একজন করে মারা গেছেন। মৃতদের মধ্যে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আনওয়ার হোসেনের মাও রয়েছেন। মৃত সাতজনের মধ্যে পাঁচজনই করোনা পজিটিভ ছিলেন। সন্দেহভাজন অন্য দুজনের নমুনা পরীক্ষার জন্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এ নিয়ে গত আট দিনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা ও উপসর্গ নিয়ে মারা গেছে মোট ৬২ জন। যার মধ্যে ৩২ জন করোনা শনাক্ত রোগী।
হাসপাতাল পরিচালক আরও জানান, হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে মঙ্গলবার সকাল থেকে আগের ২৪ ঘণ্টায় ৩০ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। এদের মধ্যে ১৮ জন চাঁপাইনবাবগঞ্জের, ১০ জন রাজশাহীর ও দুইজন নাটোরের। হাসপাতালে বর্তমানে ২১৬ জন করোনায় আক্রান্ত রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে। এদের মধ্যে আইসিইউতে আছে ১৬ জন।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, মূলত যাদের অক্সিজেন সেচুরেশন কমে যাচ্ছে, তারাই হাসপাতালে ভর্তি হতে আসছেন। ফলে শতভাগ রোগীকেই অক্সিজেন দিতে হচ্ছে। সেন্ট্রাল লাইনে অক্সিজেন সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। পর্যাপ্ত সিলিন্ডার মজুদ রাখা হয়েছে। আরও একটি ওয়ার্ডে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা চালুর কাজ চলছে। অক্সিজেনের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান লিন্ডে বাংলাদেশের অক্সিজেন ভর্তি রিজার্ভ রাখা হয়েছে। তবে রোগী বাড়তে থাকলে অক্সিজেন নিয়েও সংকটে পড়তে হতে পারে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিভিল সার্জন জাহিদ নজরুল চৌধুরী জানান, তাদের জেলায় এ পর্যন্ত এক হাজার ৭২৭ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৬০০ জনের মতো শনাক্ত হয়েছে গত ঈদের পর থেকে। ঈদের আগে নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ছিল ১৪ শতাংশ, সেখানে কয়েক দিনের মধ্যে বাড়তে বাড়তে ২৬ মে ৫৫ শতাংশ এবং তারপর ৬২ শতাংশে উঠেছিল। তবে পরে একটু কমেছে। কিন্তু রোববার ফের সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২.৪৫ শতাংশে।
সিভিল সার্জন আরও জানান, এ জেলায় এখন ৫৭৬ জন করোনা রোগী আছেন। তাদের মধ্যে জেলার তিন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ২২ জন। জেলা সদর হাসপাতালে ১৯ জন, শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দুজন এবং গোমস্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন চিকিৎসাধীন আছেন। এর বাইরে সদর হাসপাতালে করোনার উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসাধীন আছেন ১৬ জন। অনেক রোগী বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর শিবগঞ্জ উপজেলার রোগীদের বড় অংশ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে যাচ্ছেন, যার খোঁজ তাদের কাছে আসছে না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালে করোনা ইউনিটের সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা ডা. নাহিদ ইসলাম মুন জানান, তাদের ওখানে করোনা রোগীদের জন্য ১৯টি সিট আছে। সেখানে এখন ১৯ জন রোগীই ভর্তি আছেন। তাদের মধ্যে একজন ভারতফেরত। তিনি বাদে বাকি সবাইকে অক্সিজেন দিতে হচ্ছে। প্রতিদিনই হাসপাতালে ভর্তির মতো অনেক রোগী আসছে। কিন্তু সিট না থাকায় নতুন রোগী ভর্তি করা সম্ভব হচ্ছে না।
অক্সিজেন সংকট নিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, তাদের এখানে ভর্তি রোগীদেরই ঠিকমতো অক্সিজেন সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। হাসপাতালে মোট ৬০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে। সেগুলোর মধ্যে ৩০টি ব্যবহার করা যায়, বাকি ৩০টি অক্সিজেন ভরে আনার জন্য পাঠাতে হয়। কিন্তু ঠিকমতো অক্সিজেন পাওয়া যাচ্ছে না। স্পেকট্রা নামের একটি কোম্পানি মানিকগঞ্জ থেকে অক্সিজেন এনে সরবরাহ করে। তারা এখন ঠিকমতো দিতে পারছে না।
স্পেকট্রার পক্ষ থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়াও রাজশাহী ও নাটোর এলাকায় অক্সিজেন সরবরাহের দায়িত্বে আছেন মীর আখতারুল ইসলাম। তিনি বলেন, হঠাৎ করে রোগী বেড়ে যাওয়ায় অস্বাভাবিক চাপ তৈরি হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের করোনা রোগীরা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হচ্ছেন। সেখানে প্রতিদিন প্রায় দেড়শ জনকে অক্সিজেন দিতে হচ্ছে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের দুটি পিসিআর ল্যাবে ৩১ মে সোমবার ৩১৩ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১৩৪ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার প্রায় ৪৩ শতাংশ।
এদিকে, সীমান্তবর্তী রাজশাহী, নাটোর ও নওগাঁ জেলায় নতুন করে লকডাউন দেওয়া হবে কি না, তা বুধবার অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিভাগীয় কোর কমিটির সভায় আলোচনা হবে জানিয়েছেন রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল।
এদিকে, মঙ্গলবার দুপুরে রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাবিবুল আহসান স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় বিভাগের আট জেলায় ৩৮২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহীর ১৯৮ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ২১ জন, নওগাঁর ৬৭ জন, নাটোরের ১৭ জন, জয়পুরহাটের ২৯ জন, বগুড়ার ১২ জন, সিরাজগঞ্জের ২০ জন ও পাবনার ১৮ জন।