রাজশাহী থেকে আম যাচ্ছে যুক্তরাজ্যে
রাস্তার দুই ধারে সারি সারি আম বাগান আর সুস্বাদু-বাহারি জাতের আমের কথা উঠলেই চলে আসে রাজশাহী অঞ্চলের নাম। এই জেলা আমের জন্য বিখ্যাত। আর এই আমের মধ্যে বাঘা ও চারঘাট উপজেলায় সবচেয়ে বেশি গুণগতমানের আম উৎপাদন হয়। তিন বছর ধরে এই দুই উপজেলার আম রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ছয়টি দেশে। করোনা মহামারির কারণে গত বছর আম রপ্তানি করা না গেলেও এ বছর আবারও আম রপ্তানি করা হচ্ছে।
গতকাল শুক্রবার প্রথম চালানে রাজশাহীর চারঘাটের পাকুড়িয়া থেকে তিন টন হিমসাগর ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। ঢাকার শ্যামপুরে অবস্থিত সেন্ট্রাল প্যাকেজিং হাউজ আজ শনিবার আমগুলোকে যাচাই-বাছাই শুরু করেছে। যাচাই-বাছাই শেষে তাদের ক্লিয়ারেন্স পেলে ফুড অ্যান্ড ভেজিটেবল এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে আমের প্রথম এই চালানটি যুক্তরাজ্যে পৌঁছাবে।
প্রথম চালানের তিন টন আমের মধ্যে ডিপ ইন্টারন্যাশনাল নিয়েছে ছয়শ কেজি, তাছফিক ইন্টারন্যাশনাল এক হাজার কেজি, ফারডন ইন্টারন্যাশনাল ছয়শ কেজি এবং এনইবিসি করপোরেশন নিয়েছে চারশ কেজি আম। প্রথম চালানের এই আমগুলো সরবরাহ করেছে বাঘা উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লিড ফার্মার শফিকুল ইসলাম সানা। করোনা সংক্রমণের মধ্যেও দেশের বাইরে আম রপ্তানি করতে পারায় চারঘাট ও বাঘা উপজেলার অন্য আম চাষিদের মনে দেখা দিয়েছে আশার আলো।
শনিবার সকালে কনট্রাক্ট ফার্মার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুল ইসলাম সানা বলেন, ‘রাজশাহীর আম যাচ্ছে বিদেশে। এর চেয়ে আনন্দের আর কী আছে! করোনার কারণে গত মৌসুমে আম পাঠানো সম্ভব হয়নি। এ বছর চাষিরা বিদেশে আম পাঠাতে পারছেন। এতে দেশের অর্থনীতিতে আমরা ভূমিকা রাখতে পারব।’
বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতান জানান, আম রপ্তানির জন্য উপজেলার ২০ জন চাষিকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাগানে উৎপাদিত ও ক্ষতিকর রাসায়নিকমুক্ত আম ঢাকায় বিএসটিআই ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এরপর রপ্তানি করা হয়।
শফিউল্লাহ সুলতান বলেন, ‘আমে যাতে কোনো ধরনের পোকার আক্রমণ না হয়, সেজন্য এলাকার চাষি ও ব্যবসায়ীরা ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে আম চাষ করেছেন। এতে খরচ বাড়লেও একদিকে আমের গুণগত মান বেড়েছে, অন্যদিকে দেশ-বিদেশের ক্রেতারা বেশি দামে আম কিনছেন’।
কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘জেলার অন্য উপজেলার তুলনায় বাঘা-চারঘাটে সবচেয়ে বেশি গুণগতমানের আম উৎপাদন হয়। এখানকার আম আরও উন্নত পদ্ধতিতে উৎপাদন হচ্ছে বলেই রপ্তানি হচ্ছে। এ বছর বাঘা থেকে প্রায় ৩০০ টন আম রপ্তানির পরিকল্পনা রয়েছে। গত বছর এখান থেকে আম রপ্তানি হয়নি। এর আগের বছর ৩৫ টন আম রপ্তানি হয়েছিল। রাজশাহী জেলায় উৎপাদিত আমের অর্ধেক উৎপাদিত হয় বাঘায়। এখানে প্রতি বছর প্রায় এক লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হয়।
এদিকে রাজশাহী সেনানিবাসের পাশে পাঁচ বিঘা আয়তনের একটি আমবাগানে ফ্রুট ব্যাগিংয়ের উদ্বোধন করেছেন সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। মেয়র লিটন বলেন, রাজশাহীর আম ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। রাজশাহী কৃষিপ্রধান অঞ্চল। এ অঞ্চলে কৃষিপণ্যভিত্তিক শিল্পকারখানা গড়ে তোলা সম্ভব হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।
রাজশাহী অ্যাগ্রো ফুড প্রডিউসার সোসাইটির সভাপতি আনোয়ারুল হক জানান, তাদের সংগঠনের ২০০ জন সদস্য এবার কমপক্ষে ৫০ লাখ আমে ফ্রুট ব্যাগিং করছে। এতে উৎপাদন হবে প্রায় এক হাজার মেট্রিক টন আম। এর মধ্যে ৩০০ মেট্রিক টন আম বিদেশে রপ্তানি করা হবে।
আনোয়ারুল হক বলেন, আম রপ্তানি করতে হলে অবশ্যই ফ্রুট ব্যাগিং করতে হয়। ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে উৎপাদিত আম নিরাপদ, বালাইমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত। রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আম ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, রাজশাহীতে এ বছর ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমিতে আম উৎপাদিত হয়েছে। এ বছর হেক্টর প্রতি ১১ দশমিক ৯ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে জেলায় এ বছর মোট দুই লাখ ১৯ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কে জে এম আবদুল আউয়াল বলেন, ‘ফ্রুট ব্যাগিং ব্যবহার বেসরকারিপর্যায়ে হয়ে থাকে। তাই কত আমে ব্যাগিং হচ্ছে, তার সঠিক হিসাব নেই। তবে আমরা সবসময় চাষিদের ফ্রুট ব্যাগিং করে আম উৎপাদনে উৎসাহ দিয়ে থাকি। এ পদ্ধতিতে আম উৎপাদন করা হলে রপ্তানি না হলেও বেশি দামে সেই আম দেশেই বিক্রি করা যায়। অনেক মানুষ আছেন, যারা টাকা বেশি লাগলেও নিরাপদ আমটি খেতে চান।’