‘সাংবাদিক হিসেবে ভাগ্যবান মনে হয়, আমার ছবিগুলো তদন্তে বড় ভূমিকা রেখেছে’
স্বাধীন বাংলাদেশে কয়েকটি নৃশংস ও আলোচিত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা অন্যতম। অভিযোগ আছে—তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে এ হামলা চালানো হয়। হামলায় শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় কয়েক জন নেতা সেদিন অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও, আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। এ ছাড়া ওই হামলায় আরও ৪০০ জন আহত হন। আহতদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাঁদের কেউ কেউ আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি।
সেদিন ঘটনাস্থল ঢাকার ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছিলেন ফটোসাংবাদিক জিয়া ইসলাম। জিয়া ইসলাম বর্তমানে একটি শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমের সিনিয়র ফটোসাংবাদিক হিসেবে কাজ করছেন।
২১ আগস্টের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা হয় জিয়া ইসলামের। এনটিভি অনলাইনের পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এনটিভি অনলাইনের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ফখরুল ইসলাম শাহীন।
এনটিভি অনলাইন : আপনি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। সেদিন সমাবেশ শুরুর আগের পরিস্থিতি কেমন ছিল?
জিয়া ইসলাম : ধন্যবাদ। প্রথমে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় নিহতদের প্রতি। আমি সমাবেশ শুরুর প্রথম থেকেই ছিলাম। শেখ হাসিনা যখন বক্তব্য দেওয়া শুরু করলেন, তখন ছবি তোলার জন্য ভালো পজিশন খুঁজে তোলা শুরু করলাম। কিন্তু, ঠিক মনোমতো হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল আরেকটু বেটার ফ্রেম করা উচিত। এই করতে করতে যেহেতু অস্থায়ী মঞ্চটি ছিল একটি ট্রাকের ওপর, সেখানে কিছু চেয়ার রাখা ছিল, আমি তখন একটি চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে গেলাম। সে জায়গায় দাঁড়িয়ে ছবি তোলা শুরু করলাম। তখন মোটামুটি খুশি লাগছিল, ভালো ফ্রেম আসছিল। কাজ করছিলাম, তবে আরেকটি টেনশন ছিল—সমাবেশের পর মিছিল ছিল, সেটারও ছবি তুলতে হবে। ছবি তুলতে তুলতে নেত্রীর বক্তব্যও প্রায় শেষ পর্যায়ে ছিল, তখন সেখানে আরও বেশ কয়েকজন ফটোগ্রাফারও ছিলেন। যাদের ছবি তোলা হয়নি, নেত্রীকে একটু পেছনে তাকাতে বললাম আমরা, আর তখন নেত্রী কাগজে কোনো একটি পয়েন্ট পড়ছিলেন, হয়তো পরবর্তী এজেন্ডা ঘোষণা করবেন। আর তখনই হামলাটি হলো। ফটোসাংবাদিকতা অনেকদিন ধরে করছি, তবুও তখন শব্দটা অপরিচিত লেগেছিল, যা সাধারণ ককটেল কিংবা পুলিশের টিয়ারশেলের শব্দের মত ছিল না। কেমন যেন মাটি কামড়ানো একটি আওয়াজ ছিল। প্রথমে ‘ধুপ’ করে শব্দ হলো। আমি তো ট্রাকের ওপরে ছিলাম। প্রথমে আওয়াজটা হলো ঠিক আওয়ামী লীগের অফিসের সামনে। প্রথমে ভাবলাম হয়তো ট্রাকের চাকা ফাটলো। তাই আমি আমাদের ট্রাকের চাকা দেখছিলাম। এই করতে গিয়ে আরেক পাশে দেখতে যাব, তখনই পর পর শব্দ। মুহূর্তের মধ্যে দৃশ্যপট বদলে গেল। ঘটনাগুলো সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে গেল। যেহেতু হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল, আর আমি ট্রাকের ওপরে ছিলাম, তাই হুড়োহুড়িতে ধাক্কা খেয়ে আমি পড়ে গেলাম। ট্রাকের পাটাতনের ওপর যখন পড়ে ছিলাম। আমার শরীরের ওপর নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশ পড়লেন। ট্রাকের পাটাতনের ছোট একটি ছিদ্র দিয়ে নিচে দেখলাম—আস্ত একটি গ্রেনেড।
ট্রাকটিতে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ প্রায় ৩২ থেকে ৩৫ জন মানুষ ছিলেন। তাঁদের মধ্যে দুই-তিন জন ছাড়া সবাই হামলার শিকার হয়েছিলেন, যত স্প্লিটার তাঁদের শরীরের ওপর পড়ছিল। এরপর পড়ে থাকা অবস্থায় ভিড়ের মধ্য দিয়ে, কেবল হাতটা বের করে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর যখন ট্রাক থেকে নামলাম, চারপাশে শুনছি মানুষের আর্তনাদ, দেখলাম চেনা-পরিচিত অনেক মানুষ, নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে নিয়ে গাড়ির দিকে এগোচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখলাম আইভি আপা দুই পা ছড়িয়ে শুধু তাকিয়ে আছেন এক দিকে। বোঝা যাচ্ছে, শরীরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তখনই তিনি কোমার মতো অবস্থায় চলে গেছেন।
বেশ কিছু ছবি তোলার পর আহত মানুষদের সাহায্য করছি, কী যে ভয়ংকর একটা অবস্থা। অনেক সিনিয়র নেতাকর্মীই তখন রক্তাক্ত।
এনটিভি অনলাইন : ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা কেমন ছিল? কোনো অসামঞ্জস্যতা খেয়াল করেছেন কি?
জিয়া ইসলাম : অন্যান্য সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেমন থাকে, এই সমাবেশেও ছিল। তবে, সমাবেশের জনসমাগম হিসেবে শুরুর দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পর্যাপ্ত পরিমাণে ছিল না। গ্রেনেড বিস্ফোরণের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেকেই এসেছিলেন। তবে, শুরুর দিকে তেমন প্রস্তুতি ছিল বলে মনে হয়নি। খুব দায়সারা ভাবের মনে হয়েছে।
এনটিভি অনলাইন : বিস্ফোরণের পর যখন মানুষজন হতাহত হলো, তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা কেমন ছিল?
জিয়া ইসলাম : যদিও আমি আইন বিশেষজ্ঞ নই, তবে সাধারণ চোখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অগোছালো মনে হয়েছিল। গ্রেনেড বিস্ফোরণের পর ওপর থেকে হয়ত কেউ নিক্ষেপ করেছে, এই ভেবে ফাঁকা গুলি ছোড়া, এরপর আবার আরেক দিকে ফাঁকা গুলি ছোড়া, তখন মনে হয়েছে যথাযোগ্য অবস্থাটা সৃষ্টি হয়নি বরং প্যানিক সৃষ্টি করা হয়েছে।
এনটিভি অনলাইন : আপনি বলেছিলেন যে সেদিন আপনি অনেক মানুষের নিচে পড়েছিলেন, সেদিন আপনি আহত হয়েছিলেন কি?
জিয়া ইসলাম : না। অনেক মানুষ আমার ওপরে থাকায় স্প্লিনটারগুলো আমার শরীরে এসে পড়েনি। সব আমার ওপরে থাকা মানুষগুলোর গায়ে পড়েছে। তবে, আমি ঘোরের মধ্যে ছিলাম—চারদিকে এত মানুষ মরে পড়ে আছে। ঘোরের মধ্যেই অনেকগুলো ছবিই তুলেছিলাম। কিন্তু, আমি আমার ফ্রেম ঠিক রাখতে পারিনি আর তখন। আসলে সেদিন শুরুর দিকে ঠিক থাকলেও, পরে আমার মানসিক অবস্থা ঠিক ছিল না। তখন প্রথম আলোর ফটোসাংবাদিক ছিলাম। ছবিগুলো নিয়ে অফিসে গেছি ঠিকই, কিন্তু ছবিগুলো অফিসে বুঝিয়ে দিতে সেদিন আমি পারিনি।
এনটিভি অনলাইন : আপনার তোলা সেদিনের ছবিগুলো দেশের অনেক জাতীয় পত্রিকায়ও ছাপানো হয়েছিল এবং গ্রেনেড হামলা ঘটনাটির একজন চাক্ষুষ সাক্ষীও ছিলেন। পরবর্তীকালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় মামলা হলো, তদন্তও হচ্ছিল। আমরা দেখেছি মামলাটি বিভিন্ন দিকে মোড়ও নিয়েছিল। সে প্রভাবের আওতায় কি আপনি পড়েছেন পেশাগত দায়িত্ব পালনে?
জিয়া ইসলাম: বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল ঘটনাটিকে। এসব হতে হতে আজ কয়েক জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হলো। আমরা ফটোসাংবাদিকেরা যখন অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করতে যাই, নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকে, তারপরও কাজগুলো করি। সেদিনও সমাবেশে কীভাবে ছবি তুলব, কতগুলো ছবি তুলব—সব পরিকল্পনা করা ছিল। বেশকিছু ছবিও তুলেছি। এরপর যখন আবার তদন্ত শুরু হলো, আমার মনে আছে যেহেতু সেদিনের ঘটনার ছবিগুলো সিরিজ আকারে আমার কাছে ছিল, সরকারের যে গোয়েন্দা বাহিনীগুলো আছে, তারা ছবিগুলো চাইল ছবিগুলো থেকে কোনো ক্লু বের করতে পারা যায় কি না সেজন্য। তখন ফটোসাংবাদিক হিসেবে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হলো। আমার ধারণা, ছবিগুলো তদন্তে একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। সেদিনের সে ছবি আর ভিডিওগুলো দেখে কোন মানুষজন সেখানে উপস্থিত ছিল, কোন দিক থেকে গ্রেনেডগুলো নিক্ষেপ করা হয়েছে, সেসব তথ্য বের করা হয়েছে। এজন্য আমার মনে হয়—সাংবাদিকতার কাজগুলো করার সময় তাঁদের সহযোগিতা করা উচিত, কারণ সহযোগিতা না করলে আমরা প্রকৃত বিষয় জানতে পারতাম না। ঘটনাটি নিয়ে জজ মিয়ার নাটক সাজানো—কত কিছু হলো, কিন্তু পরে যখন প্রকৃত তদন্ত হলো, তখন সে ছবির তথ্যগুলো কাজে এলো যে, দেখো সেদিন কী কী হয়েছিল। তদন্তকারী সংস্থা থেকে আমার ছবিগুলো চাওয়া হলো। পরে জানতে পারলাম সেখান থেকেও তাঁদের বড় একটি সাপোর্ট হয়েছে।
সেদিনের তোলা ছবিগুলো যখন তদন্তের কাজে এলো, যাদের শাস্তি পাওয়া উচিত সে স্বার্থে ছবিগুলো ব্যবহার হচ্ছে—তখন মনে হলো সাংবাদিকদের নিউজ কাভারে সংশ্লিষ্টদের উচিত যথাসম্ভব সাহায্য করা। কারণ পরবর্তীকালে হয়তো এই ছবিগুলো, নিউজগুলো কাজে আসতে পারে। তাহলে বিষয়গুলো সমাধান আরও সহজ হয়।