সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব ও হাতি মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ায় হাতি সংরক্ষণে একটি নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বন বিভাগ। এ প্রকল্পের আওতায় মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব নিরসনের লক্ষ্যে ঝুঁকিপূর্ণ বনাঞ্চল ও গ্রামের মধ্যে ইকোলজিক্যাল সীমানায় সৌর বিদ্যুৎ চালিত ১০০ কিলোমিটার বেড়া তৈরি করা হবে। হাতি সংরক্ষিত এলাকার পাশে গঠন করা হবে উপদ্রব বিরোধী স্কোয়াড। দলছুট হাতির বাচ্চার জন্য করা হবে ‘হাতি এতিমখানা’। এ ছাড়া হাতি সংরক্ষণে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রকল্পের অধীনে একজন ‘হাতি দূত’ নিয়োগ করা হবে।

বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ সার্কেলের বন সংরক্ষক মোল্লা রেজাউল করিম বলেন, “তারা ইতিমধ্যে ‘হাতি সংরক্ষণ প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প  তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনের কাছে পাঠিয়েছে।” তিনি বলেন, ‘পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন পাওয়া মাত্রই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করবে বন বিভাগ।’

রেজাউল করিম বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়নকালে হাতির প্রাকৃতিক আবাসস্থল উন্নয়নে নিরাপদ প্রজনন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

হাতির আবাসস্থল এর বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য দলগতভাবে স্থায়ী ও অস্থায়ী হাতির সংখ্যা নির্ধারণের জন্য জরিপ, গতিবিধি নিরূপণের জন্য গবেষণা ও মানুষ-হাতি দ্বন্দ নিরসনে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে বলে জানান এ কর্মকর্তা।

বন বিভাগ সূত্র জানায়, প্রকল্প বাস্তবায়নকালে কালে হাতির আবাসস্থল উন্নয়ন, নিরাপদ প্রজনন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে হাতির খাদ্য উপযোগী গাছের ১৪০০ হেক্টর বাগান, ১৫০ হেক্টর বেত বাগান এবং ২৫০ হেক্টর বাঁশ বাগান সৃজন করা হবে।

হাতির আবাসস্থলে দৈনন্দিন পানির চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য নিরাপদ জায়গায় ছোট-বড় ১৫টি জলাধার ও ৫০ টি সল্টলেক স্থাপন করা হবে।

মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব নিরসনের লক্ষ্যে ঝুঁকিপূর্ণ বনাঞ্চল ও গ্রামের মধ্যে ইকোলজিক্যাল সীমানায় সৌর বিদ্যুৎ চালিত ১০০ কিলোমিটার বেড়া তৈরি করা হবে। এ ছাড়াও মানুষ-হাতি দ্বন্দ নিরসনের লক্ষ্যে ইকোলজিক্যাল বাউন্ডারি বায়ুফেন্সিং নির্মাণের জন্য (কাঁটাতার ও আরসিসি পিলারসহ) ১৬০ কিলোমিটার বেত, লেবু ও বড়ই জাতীয় কাঁটা গাছের বাগান সৃজন করা হবে।

হাতি সংরক্ষিত এলাকার পাশে উপদ্রব বিরোধী স্কোয়াড (এন্টি ডিপ্রেডেশন স্কোয়াড) গঠন করা হবে। পাশাপাশি হাতি-মানুষ দ্বন্দ নিরসনে বর্তমানে চলমান ১২৭টি এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের পাশাপাশি আরো ৬৮ টি নতুন টিম গঠন করা হবে। এই টিমগুলোর মাঝে হাতি উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্য বিভিন্ন সরঞ্জাম বিতরণ করা হবে।

হাতির গতিবিধি ও চলাচল পর্যবেক্ষণের জন্য ৯০টি আরসিসি টাওয়ার ও বড়ই গাছে সনাতন পদ্ধতিতে একশটি টাওয়ার নির্মাণ করা হবে।

প্রকল্প প্রস্তুতের সাথে সম্পৃক্ত এক বন কর্মকর্তা জানান, অসুস্থ হাতি ও দলছুট হাতির বাচ্চার জন্য একটি হাতি এতিমখানা বা হাতি উদ্ধার কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। পাশাপাশি হাতির আবাসস্থলের বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য ও হাতির সংখ্যা নির্ধারণের জন্য একটি জরিপ পরিচালনা করা হবে।

প্রকল্প চলাকালে হাতির অপছন্দনীয় খাদ্য চাষাবাদে বিশেষ করে আদা, হলুদ, লেবু, মাল্টা, মরিচ ও আনারস চাষে কৃষকদের বীজ ও চারা বিতরণ করা হবে। এতে একশ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। হাতি সংরক্ষণে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রকল্পের অধীনে একজন ‘হাতি দূত’ নিয়োগ করা হবে।

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ময়মনসিংহ এবং সিলেটের বনাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বন্য হাতি পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে হাতির আবাসস্থল ও চলাচলের করিডোর ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। বনভূমিতে মানুষের বসতি, অনুপোযোগী কৃষিকাজ ও অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট নির্মাণের ফলেও হাতির আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে।

বেসরকারি তথ্যমতে, শুধুমাত্র ২০২১ সালেই বিভিন্ন ঘটনায় ৩৪টি হাতি মারা যায়। রেজাউল করিম বলেন, গত পাঁচ বছরে সারাদেশে কমপক্ষে ৫০টি হাতি হত্যা করা হয়েছে।

আইইউসিএন বাংলাদেশের ২০১৬ সালের এক জরিপে দেখা যায়, সে সময় বন্য হাতির সংখ্যা ছিল ২৬৮টি এবং তাদের সবগুলোই ছিল দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বনভূমিতে। হাতির আবাসস্থল ধ্বংস, বনভূমি ধ্বংস ও চোরাই শিকারের ফলে এর সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে বাংলাদেশে। তাই এশিয়ান হাতি বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।