১৩৮ জনের নিয়োগ স্থগিত, রাবি উপাচার্যের দুর্নীতির ব্যবস্থা নিতে রুল
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আবদুস সোবহানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে ব্যবস্থা না নেওয়া কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে তার মেয়াদের শেষের দিকে গত ৫ মে ১৩৮ জনকে দেওয়া সব নিয়োগ স্থগিত করেছেন আদালত।
এ ছাড়া ২০১৭ সালের শিক্ষক নিয়োগের বিশ্ববিদ্যালয় নীতিমালাও স্থগিত করেছেন আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে ৬০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
এ সংক্রান্ত এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে আজ সোমবার বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি কামরুল হোসেন মোল্লার হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
রিটকারীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নওরোজ মুহাম্মদ রাসেল।
এ বিষয়ে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এনটিভি অনলাইনকে বলেন, গত ৩১ আগস্ট হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। প্রকাশ্যে দুর্নীতির বিষয়টি আসার পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ বিষয়টি আমরা আদালতকে জানিয়েছি। আদালত উপাচার্য আবদুস সোবহানের শেষ সময়ে ১৩৮ জনকে নিয়োগ স্থগিত করেছেন। আবদুস সোবহানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে ব্যবস্থা না নেওয়া কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে অধ্যাপক এম আবদুস সোবহানের শেষ কর্মদিবস ছিল গত ৬ মে। ওইদিন দুপুরে পুলিশ পাহারায় ক্যাম্পাস ত্যাগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী বিহাস এলাকায় নিজের বাসায় গিয়ে ওঠেন তিনি। তাঁর ক্যাম্পাস ত্যাগের পর জানা যায়, আগের দিনের তারিখ দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদে বেশ কিছু নিয়োগ দিয়ে গেছেন তিনি। নিয়োগের খবর জানাজানি হলে নিয়োগপ্রাপ্ত এবং নিয়োগবঞ্চিত ছাত্রলীগের দুপক্ষের মধ্যে ক্যাম্পাসে সংঘর্ষ হয়। বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের দুর্নীতিবিরোধী পক্ষ। বিষয়টি জেনে ওইদিন সন্ধ্যায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় অধ্যাপক আবদুস সোবহানের শেষ কর্মদিবসে দেওয়া নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা দিয়ে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির আহ্বায়ক করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীরকে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. আবু তাহের, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব জাকির হোসেন আকন্দ ও ইউজিসির পরিচালক জামিনুর রহমান। কমিটিকে অবৈধ এসব নিয়োগে জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, তার সুপারিশ দিতেও বলা হয়। সরেজমিন তদন্ত শেষে ২৩ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে এই কমিটি।
বিষয়টি নিশ্চিত করে কমিটির প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, কমিটি গঠনের পর গত ৮ মে তারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনসহ বিতর্কিত এসব নিয়োগের নথিপত্র সংগ্রহ এবং এর সঙ্গে জড়িত ছাড়াও রাবির বিভিন্ন বিভাগের সভাপতি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং প্রগতিশীল ও দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন। কমিটি রাবি রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আব্দুস সালাম, বিদায়ী ভিসি অধ্যাপক এম আবদুস সোবহানসহ দুই উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা ও অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়ার বক্তব্য রেকর্ড করেন। জড়িত কর্মকর্তারা কমিটির কাছে দেওয়া বক্তব্যে নিজেদের বিতর্কিত নিয়োগে জড়িত নন বলে দাবি করেছিলেন। তবে ভিসি আবদুস সোবহান এসব নিয়োগের সব দায় তাঁর বলে নিজেই দায়িত্ব স্বীকার করেন।
কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে তারা রোববার মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন। প্রতিবেদনে দেওয়া নয়টি সুপারিশ মন্ত্রণালয়ই বাস্তবায়ন করবে। তারা শুধু বিতর্কিত নিয়োগে জড়িতদের চিহ্নিত ও তাদের দায়দায়িত্ব নিরূপণ করেছেন। কমিটিকে নির্দিষ্টভাবে এ কাজটি করতে বলা হয়েছিল।
তদন্ত কমিটি সূত্রে আরও জানা গেছে, বিদায়ী ভিসি সোবহানের দেওয়া বিতর্কিত ১৪১ নিয়োগ বাতিল ছাড়াও তাঁর মেয়ে সানজানা সোবহান ও জামাই এ টি এম শাহেদ পারভেজসহ আগে দেওয়া আরও ৩৪ জন শিক্ষকের নিয়োগও বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
কমিটি সূত্র বলছে, গত ১০ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভিসি অধ্যাপক আবদুস সোবহানকে চিঠি দিয়ে তাঁর মেয়ে জামাতার নিয়োগ বাতিলসহ রাবিতে সব প্রকার নিয়োগ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে বিদায়ের একদিন আগে তিনি ১৪১ জনকে নিয়োগ দেন। এ ছাড়া অধ্যাপক আবদুস সোবহান তাঁর মেয়ে জামাতার নিয়োগ বাতিল করেননি। বরং সিন্ডিকেট সভা ডেকে তা স্থায়ী করেন গত ৩ মে বিদায়ের ঠিক তিনদিন আগে।
কমিটি সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার আলোকে নিয়োগের ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের চিহ্নিত করেছে তদন্ত কমিটি। এ নিয়োগকে কেন্দ্র করেই নয় দফা সুপারিশ এসেছে। কমিটির প্রতিবেদনে বিতর্কিত ১৪১ জনের নিয়োগের ঘটনায় বিদায়ী ভিসি অধ্যাপক আবদুস সোবহানকে মূল অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এসব নিয়োগে বিদায়ী ভিসির সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তাঁর জামাতা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর প্রভাষক এ টি এম শাহেদ পারভেজকে। তাঁর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নিয়োগে স্বাক্ষরকারী সংস্থাপন শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার ইউসুফ আলী, রেজিস্ট্রার শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার তারিকুল আলম ও পরিষদ শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার মামুন অর রশীদকে সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করেছে তদন্ত কমিটি।
কমিটি তদন্তে পেয়েছেন যে রাবির রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আব্দুস সালাম এসব নিয়োগে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেন। ফলে বিদায়ী ভিসি অধ্যাপক আবদুস সোবহান বিকল্প হিসেবে ডেপুটি রেজিস্ট্রার ইউসুফ আলী, সহকারী রেজিস্ট্রার তারিকুল আলম ও মামুন অর রশীদকে কাজে লাগান। এই তিন কর্মকর্তা নিজেদের আত্মীয়স্বজনকে চাকরি পাইয়ে দিতে অধ্যাপক আবদুস সোবহানের ক্রীড়নক ও মূল সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন বলে তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নিয়োগের দুদিন আগে গত ৩ মে গভীর রাতে অধ্যাপক আবদুস সোবহানের জামাতা প্রভাষক এ টি এম শাহেদ পারভেজের নেতৃত্বে সিনেট ভবন থেকে ১৪১ জনসহ বিভিন্ন নিয়োগসহ বিদায়ী ভিসির বিভিন্ন দুর্নীতি অনিয়মের গুরুত্বপূর্ণ নথি সরিয়ে ফেলা হয়। বিদায়ী ভিসির এসব কাজে সহায়তা করেন উপরেজিস্ট্রার ইউসুফ আলী, সহকারী রেজিস্ট্রার তারিকুল আলম ও মামুন অর রশীদ।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ভাই ও সন্তানের নিয়োগ নিশ্চিত করতেই অবৈধভাবে দেওয়া এ গণনিয়োগে রাবির এই তিন কর্মকর্তা ভিসি আবদুস সোবহানকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেন। তিন কর্মকর্তার মধ্যে ইউসুফ আলীর স্বার্থ ছিল নিজের ছেলেকে চাকরি পাইয়ে দেওয়া। নিয়োগ তালিকা অনুযায়ী তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী পদে ৮৫ জনের তালিকার মধ্যে ৮২ নম্বরে আছেন ডেপুটি রেজিস্ট্রার ইউসুফ আলীর ছেলে নাহিদ পারভেজের নাম। সিনিয়র সহকারী পদের বিপরীতে নিম্নমান সহকারী হিসেবে সংস্থাপন শাখায় তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়। অন্য দুই কর্মকর্তার স্বার্থ ছিল নিজের ভাইয়েদের নিয়োগ নিশ্চিত করা। এর মধ্যে তারিকুল আলমের ভাই রফিকুল আলম সেকশান অফিসার ও আরেক ভাই শরিফুল আলমকে নিম্নমান সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আর তালিকার ৬৮ নম্বরে থাকা শেখ ফারহানুল ইসলাম পরিষদ শাখার কর্মকর্তা নিয়োগ পান সহকারী রেজিস্ট্রার মামুন অর রশীদের ভাই।
তদন্ত প্রতিবেদনে অধ্যাপক আবদুস সোবহানের দেওয়া এ অবৈধ নিয়োগের সুবিধাভোগী বেশ কয়েকজন শিক্ষকের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব শিক্ষকদের স্ত্রী, সন্তান, জামাতাসহ বিভিন্ন নিকটাত্মীয় অবৈধভাবে নিয়োগ পেয়েছেন এবারে ও আগের বিভিন্ন নিয়োগে। এজন্য অবৈধ এ নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঘটে যাওয়া এত বড় অবৈধ নিয়োগ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় রাবির বর্তমান দুই উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা ও অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়া এবং কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের নীরব ভূমিকাকেও দায়ী করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দুই উপ-উপাচার্য নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখলে এ নিয়োগ প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল বলে কমিটি মনে করেছে। এজন্য এসব অবৈধ নিয়োগে দায় তাঁরাও এড়াতে পারেন না।
তদন্ত কমিটি অধ্যাপক আবদুস সোবহানের বিদেশ গমনের ওপর নিষেধাজ্ঞারও সুপারিশ করেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অধ্যাপক আবদুস সোবহান বাংলাদেশ ছাড়াও আরেকটি দেশের নাগরিক। এ হিসেবে তিনি দ্বৈত নাগরিক হিসেবে যেকোনো সময় বিদেশে চলে যেতে পারেন। এ কারণেই তাঁর বিদেশ গমনের ওপর নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ এসেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেন তদন্ত কমিটির একাধিক সদস্য।
রাবির প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের কো-কনভেনার ড. সৈয়দ মুহাম্মদ আলী রেজা বলেন, ভিসিকে যেমন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন, তেমনি প্রো-ভিসি, কোষাধ্যক্ষও রাষ্ট্রপতি কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত। সুতরাং তাঁরা কখনই ভিসির আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করতে পারেন না। তাঁরা চাইলে ভিসির অনেক অনিয়ম বাধা দিতে পারতেন। সেটা না করে সহযোগিতা এবং নীরব থেকেছেন। অন্যায়কারী ও অন্যায়ে সহযোগিদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ পেলে দেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।