৩৭ বছর পর মায়ের দেখা
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/07/01/photo-1435707645.jpg)
‘মা, আমার মা কলিজার টুকরা। অভাবে তোমারে আমার বুক থেকে কাড়ি নেওয়া হইছিল। তোমার খোঁজে দাকোপ আর মংলায় খুঁজি পাগল। তোমার বাপ বলছে, মেয়েটারে চোরে নিয়ে গেছে। আমি আল্লাহর কাছে বারবার বলছি, যেথায় থাক না কেন, আমার বুকের ধন যেন বেঁচে থাকে। শুনেছি, গরিবের কথা আল্লাহতায়ালা ফেলে না। দেখছি তা-ই হলো, তুমি বেঁচে আছো।’ এসব কথা বলতে বলতে ৩৭ বছর পর ফিরে পাওয়া মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন হতদরিদ্র নূরজাহান বেগম। জন্মদাত্রী মায়ের কান্নায় নিজেকেও স্বাভাবিক রাখতে পারেনি আমেরিকাপ্রবাসী এস্থার জামিনা জডিং। বাংলায় কথা বলতে না পারলেও ‘মা মা’ বলে বারবার চিৎকার করে হারানো মাকে কাছে পেয়ে বুকে চেপে ধরে রেখেছিল। গতকাল মঙ্গলবার খুলনা শহরে এ দৃশ্যের অবতারণা হয়।
urgentPhoto
ঘটনার অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৭৭ সালে খুলনার দাকোপ উপজেলার গুনারী গ্রামের নূরজাহান বেগম ও মোহন গাজী দম্পতির ঘরে পঞ্চম সন্তান হিসেবে জন্ম হওয়া মেয়ের নাম রাখা হয় জামিলা। হতদরিদ্র এই দম্পতি তখন বসবাস করতেন চালনায়। অভাবের সংসারের কর্তা অসুস্থ মোহন গাজী জন্মের পাঁচ দিনের মাথায় সুযোগ পেয়ে জামিলাকে খুলনার এজি মিশনে নিয়ে যান এবং সেখানে এক আমেরিকান দম্পতির কাছে ৫০০ টাকায় বিক্রি করে দেন। সেদিন নূরজাহান চালনায় খোয়া ভাঙার কাজ করতে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে আর মেয়েকে পাননি। স্বামী মোহন তাঁকে জানান, মেয়েকে বারান্দা থেকে কেউ হয়তো নিয়ে গেছে। এর প্রায় আট মাস পর মেরি ও পেট দম্পতি খুলনার এজি মিশনে আসেন এবং তাঁরা জামিলাকে দত্তক নিয়ে আমেরিকা চলে যান। এর পর জামিলা হয়ে যায় এস্থার জামিনা জডিং। লেখাপড়া শেষ করে জামিনা এখন নিউইয়র্কে চাকরি করছেন। তাঁর রয়েছে তিন ছেলে। স্বামী ল্যান্স জডিং পেশায় কেমিস্ট।
জমিনা জেডিং এনটিভিকে জানান, ২০১৩ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে জামিনার সঙ্গে পরিচয় হয় যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশি নওরীন সায়রার। সেই সূত্র ধরে সামাজিক যোগাযোগের আরেক মাধ্যম ফেসবুকে নওরীন সায়রার ছোট বোন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী শিক্ষিকা নাহিদ ব্রাউনের সঙ্গে পরিচয় হয় জামিনার। এর পর শুরু হয় শিকড়ের সন্ধান। জামিনার সে সময়ের বাংলাদেশি পাসপোর্টের সূত্র ধরে তাঁরা নিশ্চিত হন, জামিনার বাড়ি ছিল খুলনায়।
নাহিদ তাঁর ফুফাতো ভাই খুলনায় কর্মরত আবু শরীফ হুসেন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি (শরীফ) প্রায় এক বছর চেষ্টা করে জামিনার মা নূরজাহানের সন্ধান পান মংলায়। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে জামিনা নিশ্চিত হন, নূরজাহান বেগমই তাঁর মা। গত ২৭ জুন নাহিদ ব্রাউনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র থেকে খুলনায় আসেন জামিনা। ২৮ জুন আবু শরীফের বাসায় দেখা হয় মা-মেয়ের। ২৯ জুন জামিনা যান দাকোপে নিজ বসতভিটায়। সেখানে তিনি তিন বোন ও রিকশাচালক ভাইয়ের সঙ্গে সারা দিন কাটান। সেখান থেকে সুন্দরবন বেড়াতে যান জামিনা। বিকেলে খুলনার লবণচরা এলাকায় ফিরে আসেন। মঙ্গলবার প্রথম বেলা জামিনা লবণচরার গেস্টহাউসে সময় কাটান। এখানে তাঁর মাও ছিলেন। এখান থেকে বিকেল ৩টায় যশোর বিমানবন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ঢাকায় পৌঁছে ৪ জুলাই জামিনা আমেরিকার যাবেন।
নূরজাহান বেগম বলেন, ‘সব সময় মনে হতো, আমার মেয়ে বেঁচে আছে। ওর আসার খবর শোনার পর ঠিকমতো খেতে পারিনি। রাতে ঘুমাতে পারিনি। কখন মেয়ের সঙ্গে দেখা হবে, সে অপেক্ষায় সময় কেটেছে। এখন মেয়েকে দেখে চোখ জুড়ালাম। মেয়েকে নয়, যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি।’
গত সোমবার মংলায় মায়ের বাড়িতে এস্থার জামিনা জডিং সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি ভীষণ খুশি। মাকে দেখার অপেক্ষা আর সইছিল না। বারবার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। দুই বছর চেষ্টার পর মা-মেয়ের মিলন হয়েছে। দীর্ঘ ৩৭ বছর পর শিকড়ের সন্ধান পেলাম। মাকে পাওয়ার আনন্দটা সবার সঙ্গে শেয়ার করার জন্য শিগগিরই আমার স্বামী-সন্তানদের নিয়ে মংলায় আসব।’
জন্মের পর বিক্রি হওয়া খুলনার মেয়ে জামিলা তিন দিন মায়ের সঙ্গে কাটিয়ে মঙ্গলবার বিদায় নিয়েছেন। বিদায় বেলায় অশ্রুসিক্ত নয়নে মা নূরজাহানকে বলে যান, ‘নো মোর ফিশিং।’