রামপাল-সুন্দরবন নিয়ে যা আছে ইউনেসকোর প্রতিবেদনে
পোল্যান্ডের ক্রাকাও শহরে চলছে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যকেন্দ্রের ৪১তম বার্ষিক অধিবেশন। সুন্দরবন ও রামপাল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পকে কেন্দ্র করে এই অধিবেশন নিয়ে বাড়তি আগ্রহ তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশে। রামপাল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য সুন্দরবন ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে- এমন আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল ২০১৬ সালে ইউনেসকোর একটি প্রতিবেদনে। এবার বার্ষিক সভায় সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হতে পারে, এমন আশঙ্কাও ছিল অনেকের।
শেষ পর্যন্ত তেমনটা হয়নি। সুন্দরবন এখনো আছে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে। আর রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প চালু হলেও ইউনেসকোর আপত্তি নেই, এমনটা জানানো হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভারসাম্য বজায় রাখতে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করার জন্য কমিটিকে ধন্যবাদ।’
আসলে কী বলা হয়েছে ইউনেসকোর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে?
পোল্যান্ডে চলমান ৪১তম বার্ষিক অধিবেশন উপলক্ষে প্রকাশিত ইউনেসকোর প্রতিবেদনে চারটি পৃষ্ঠা ব্যয় করা হয়েছে সুন্দরবনের জন্য। ২০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের ৫৫ থেকে ৫৮ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিস্তারিত আলোচনা আছে সুন্দরবন, এর ইকোসিস্টেম, সুন্দরবনসংলগ্ন পশুর নদী, রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র ইত্যাদি বিষয়ে। কী বলা হয়েছে সেই প্রতিবেদনে? সত্যিই কি সুন্দরবনের কাছে কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে অনাপত্তি জানিয়েছে ইউনেসকো?
২০১৬ সালের ২২ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত সুন্দরবন এলাকা পর্যবেক্ষণ করেছিল ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচারের (আইইউসিএন) যৌথ একটি দল। সেই পর্যবেক্ষণ শেষে তারা একটা প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারও তার জবাবে আরেকটি প্রতিবেদন দাখিল করেছিল ২০১৬ সালের অক্টোবরে। এই দুটি প্রতিবেদনের উল্লেখ বারবার আছে ইউনেসকোর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনটিতে।
ইউনেসকো ও আইইউসিএনের ২০১৬ সালের প্রতিবেদনে সুন্দরবন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। এ ছাড়া উদ্বেগ ছিল রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র, পশুর নদীতে তেলবাহী ট্যাংকারডুবি ও অপরিকল্পিত ড্রেজিং নিয়ে। বিদ্যুৎকেন্দ্র অন্য কোনো জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল ইউনেসকো। বাংলাদেশ সরকার সেই প্রস্তাবে রাজি হয়নি।
তবে সুন্দরবন ও আশপাশের এলাকা নিয়ে একটি পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করার ব্যাপারে একমত হয়েছিল দুটি পক্ষ। আর সেই সমীক্ষার প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার আগে ওই এলাকায় রামপালসহ কোনো ধরনের শিল্পকারখানা না করার কথা বলা হয়েছে ইউনেসকোর তরফ থেকে। বাংলাদেশ সরকার এখনো চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়নি ওরিয়ন পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের প্রস্তাব ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণকাজ শুরুর বিষয়ে। ইউনেসকোও বাংলাদেশ সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে চলমান ৪১তম অধিবেশনের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এবং পরিবেশগত সমীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এগুলো নির্মাণের বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার যে পরিবেশগত সমীক্ষাটি করেছিল, সেটা পর্যাপ্ত না বলেও মন্তব্য করেছে ইউনেসকো। বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের সর্বশেষ এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব কমানোর বিষয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে রাষ্ট্রের (বাংলাদেশ সরকার) তরফ থেকে। কিন্তু এই পদক্ষেপগুলো যে বায়ুদূষণ, কয়লার ছাই ভেসে বেড়ানো, নদী দিয়ে কয়লা পরিবহন, ড্রেজিং ইত্যাদি বিষয়ে কার্যকর হবে, তেমন পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া যায় না। ফলে এসব কিছুর আলোকে সুপারিশ করা হচ্ছে যে, কমিটি যেন রাষ্ট্রীয় পক্ষকে অনুরোধ করে, বর্তমান স্থানে রামপাল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের সিদ্ধান্ত না নেওয়া ও এটা অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে।
রামপালে বিদ্যুৎ প্রকল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত যে যথার্থ হবে না, সেটাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে ইউনেসকোর প্রতিবেদনে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে ওই এলাকায় এ ধরনের বড় কোনো শিল্প প্রকল্পের কথা চিন্তা করলেও যে সেটা ইউনেসকো কমিটিকে জানাতে হবে, তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সুন্দরবন ও রামপাল পর্যবেক্ষণের পর পশুর নদীতে কয়েকটি কয়লা, তেল, সারবাহী জাহাজডুবি ও এর ফলে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল ইউনেসকো ও আইইউসিএনের ২০১৬ সালের প্রতিবেদনটিতে। বাংলাদেশ সরকার পাল্টা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল শুধু ২০১৪ সালের তেলবাহী ট্যাংকারডুবির বিষয়টিই। সেটাকে বর্ণনা করা হয়েছিল ‘নিছকই একটা দুর্ঘটনা’ হিসেবে। ২০১৫ সালের মে, অক্টোবর ও ২০১৬ সালের মার্চ মাসে আরো তিনটি এমন জাহাজডুবির বিষয়ে কোনো উল্লেখ ছিল না বাংলাদেশ সরকারের প্রতিবেদনে। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে ইউনেসকোর সর্বশেষ প্রতিবেদনে। সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমে এগুলোর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অস্বীকার করা যাবে না বলে মন্তব্য করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।
পশুর নদীতে অপরিকল্পিত ড্রেজিং, নোনা পানির আগ্রাসন রোধ, সুন্দরবন রক্ষায় ভারত-বাংলাদেশের যৌথ সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয় জোরদার করা ইত্যাদি বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে সর্বশেষ প্রতিবেদনে।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রভাব সম্পর্কিত পরিবেশগত সমীক্ষা ও অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন বাংলাদেশ সরকারকে জমা দিতে হবে ২০১৮ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারির মধ্যে। সেই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের ৪২তম সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে সুন্দরবন বিষয়ে। ইউনেসকোর সুপারিশ করা বিষয়গুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না করতে পারলে এটিকে যে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ তালিকায় ফেলে দেওয়া হতে পারে, সেটাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের সর্বশেষ প্রতিবেদনে।
২ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের বার্ষিক অধিবেশন চলবে আগামী ১২ জুলাই পর্যন্ত। চলমান এই অধিবেশনে কিছু খসড়া সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
তবে এগুলো এখনো চূড়ান্ত হয়নি। গৃহীত খসড়া সিদ্ধান্তগুলো হলো—
• ওরিয়ন পাওয়ার প্ল্যান্ট ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় দফার নির্মাণকাজ শুরু না করা এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে (ওই সম্পত্তি বা সুন্দরবনসহ) পরিবেশগত সমীক্ষা চালানোর (এসইএ) যে সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপক্ষ (বাংলাদেশ সরকার) নিয়েছে, তাকে স্বাগত জানায় বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষকে সুপারিশ করা হচ্ছে যে, এসইএ সম্পন্ন হওয়ার আগে ওই এলাকায় বড় ধরনের শিল্পকারখানা বা অবকাঠামো (রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ) নির্মাণ প্রক্রিয়া অনুমোদন না দেওয়ার। পর্যালোচনার জন্য এসইএর একটি অনুলিপি বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হচ্ছে।
• পরিবেশগত পর্যবেক্ষণের যে তথ্য রাষ্ট্রীয় পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে, সেটাকে স্বাগত জানাচ্ছে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি। কিন্তু এটাও উদ্বেগের সঙ্গে উল্লেখ করা যাচ্ছে যে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নোনা পানির অনুপ্রবেশ ও মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাওয়া সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ বিষয়গুলোর জন্য স্থানটি বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
• সুন্দরবনের বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ তৎপরতার কথা খুব গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করছে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি। এ ক্ষেত্রে দুই দেশ যে ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে, সেটাকে স্বাগত জানানো হচ্ছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারপক্ষকে সুপারিশ করা হচ্ছে যে, সুন্দরবনের আশপাশের নদীগুলোতে মিঠা পানির পর্যাপ্ত সরবরাহের যে প্রস্তাব ২০১৬ সালে দেওয়া হয়েছিল, সেটা যত দ্রুত সম্ভব পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা।
• ২০১৬ সালের প্রতিবেদনে অন্য যে সুপারিশগুলো করা হয়েছিল, সেগুলো পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্যও রাষ্ট্রপক্ষকে অনুরোধ করা হচ্ছে।
• “ন্যাশনাল ওয়েল স্পিল অ্যান্ড কেমিক্যাল কনটিনজেন্সি প্ল্যান” (এনওএসসিওপি)-এর খসড়া তৈরির উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছে কমিটি। একই সঙ্গে এই সুপারিশও করা হচ্ছে যে, রাষ্ট্রীয় পক্ষ যেন সেই পরিকল্পনা গৃহীত হওয়ার পর তা বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত অর্থ ও মানবসম্পদ নিয়োগের বিধান রাখে। এ ছাড়া সম্প্রতি নদীতে জাহাজডুবির ঘটনায় আরো বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত জানানোর সুপারিশ করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পক্ষকে।
• রাষ্ট্রপক্ষ পশুর নদীর অবক্ষয়ের ওপর পরিবেশগত সমীক্ষা হালনাগাদ না করায় আহত হয়েছে কমিটি। এই সমীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত আগামীতে পশুর নদীতে যেন আর কোনো অপরিকল্পিত ড্রেজিং না চালানো হয়, সেই সুপারিশ করা হচ্ছে।
• রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বায়ু ও পানিদূষণের প্রভাব সুন্দরবনে পড়ার অনেক আশঙ্কা আছে বলে মনে করছে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি। একই সঙ্গে জাহাজ চলাচল ও ড্রেজিং, মিঠা পানি সরিয়ে নেওয়ার মতো বিষয়গুলো ওই এলাকার লবণাক্ততা আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। এই প্রভাবগুলো এড়িয়ে যাওয়া যাবে-এমন কোনো পর্যাপ্ত প্রমাণ এখন পর্যন্ত নেই। ফলে কমিটি রাষ্ট্রপক্ষকে অনুরোধ করছে আইইউসিএনএর পরিবেশবিষয়ক নীতিমালা অনুসরণ করে এই বিষয়ে আরো ভালোমতো সমীক্ষা চালানোর জন্য। কমিটি এটাও সুপারিশ করছে যে, বর্তমান অবস্থানে রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজ বাস্তবায়নে যেন পরবর্তী তৎপরতা যেন না নেওয়া হয়।
• সবশেষে বিশ্ব ঐতিহ্য সংস্থা ২০১৮ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারির মধ্যে সুন্দরবনের রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে হালনাগাদ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য রাষ্ট্রপক্ষকে অনুরোধ করছে।
একই সঙ্গে উল্লিখিত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের অনুরোধ করা হচ্ছে। ২০১৮ সালের ৪২তম বার্ষিক অধিবেশনে সেটা যাচাই করা হবে। উল্লিখিত সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি না থাকলে বিশ্ব ঐতিহ্যের সুন্দরবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে।