ফাঁসির জন্য পেরোতে হবে তিন ধাপ
মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসির রায় কার্যকর করতে আরো তিনটি আইনি প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। এসব প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর রায় কার্যকর করতে আর বাধা থাকবে না। এর আগে আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ের পর দুজনের ফাঁসি কার্যকরের ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে।
প্রথমত, আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি প্রকাশ করতে হবে। এটি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে পড়ে শোনানোর পর তিনি রিভিউ (রায় পুনর্বিবেচনা) করার সুযোগ পাবেন। এ বিষয়ে রায় হাতে পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিতে বিএনপি নেতাকে ১৫ দিন সময় দেওয়া হবে।
দ্বিতীয় আইনি প্রক্রিয়া শুরু এখান থেকে। রায় রিভিউ আবেদনের পর এ বিষয়ে আপিল বিভাগে শুনানি হবে। শুনানি শেষে তাঁর আবেদন খারিজ হলে এ বিষয়ে রায়ের অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর আসামির আদালতের সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ।
বাকি থাকল তৃতীয় ও শেষ প্রক্রিয়া। এ ক্ষেত্রে সব দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ পাবেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।
কারাবিধি অনুযায়ী, একজন আসামি রিভিউ আবেদনের রায় হওয়ার পর থেকে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার জন্য সাত দিন সময় পেয়ে থাকেন। এর পর ২১ দিনের আগে নয় এবং ২৭ দিনের বেশি নয়, এমন সময়ের মধ্যে ফাঁসি কার্যকর করতে হবে। তবে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সময় নিয়ে আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। জামায়াত নেতা মুহাম্মাদ কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের সময় এই বিধি মানা হয়নি। এর কারণ হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ক্ষেত্রে কারাবিধি প্রযোজ্য নয়।
মাহবুবে আলম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার কোনো সময়সীমা নেই। যে কারণে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ হওয়ার পর প্রাণভিক্ষা বাতিল হলে সরকার চাইলে যেকোনো দিন ফাঁসি কার্যকর করতে পারবে।
অন্যদিকে, আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ হলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সময় সাত দিন দিতে হয়। এর পর আসামি প্রাণভিক্ষা না চাইলে অথবা প্রাণভিক্ষা আবেদন বাতিল হলে কারাবিধি অনুযায়ী একজন আসামিকে ২১ দিনের আগে নয় এবং ২৭ দিনের পরে নয়, এমন সময়ে ফাঁসি কার্যকর করতে হয়।’
রায় কার্যকরের বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য পূর্ণাঙ্গ রায় না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর দণ্ড কার্যকর করতে সরকার উদ্যোগ নিতে পারবে। আর আপিল বিভাগের দেওয়া সময় অনুসারে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের জন্য ১৫ দিন সময় পাবে আসামিপক্ষ। যখনই পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হবে, তখনই দণ্ড কার্যকর প্রক্রিয়া পর্যন্ত স্থগিত থাকবে।’
গত ১৬ জুন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসির দণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। ওই রায়ের এখনো পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ হয়নি। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পরই শুরু হবে পরবর্তী কার্যক্রম, অর্থাৎ রিভিউ ও ফাঁসি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াগুলো।
গত বছরের ৩ নভেম্বর আপিলের চূড়ান্ত রায়ে কামারুজ্জামানকে দেওয়া ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। ওই দিন সংক্ষিপ্ত আদেশ দেন সর্বোচ্চ আদালত। চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ পায়। এর পর ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করলে আসামির আইনজীবীরা ৫ মার্চ রিভিউ আবেদন করেন। এতে করে পরোয়ানার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। সে সময় সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটির প্রাক্কালে কামারুজ্জামানের পক্ষে করা সময়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১ এপ্রিল শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করেন আপিল বিভাগ। শুনানি শেষে ৬ এপ্রিল তাঁর পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করে দেওয়া হয়। এর পর প্রাণভিক্ষা না চাওয়ায় ১১ এপ্রিল রাতে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
এর আগে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে জামায়াতের অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল। কাদের মোল্লার মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয় ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। ওই দিন ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আপিল বিভাগ। ছয়টির মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনাল-২-এর ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা বাড়িয়ে চূড়ান্ত এ রায় প্রদান করেন সর্বোচ্চ আদালত। ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় এবং ১২ ডিসেম্বর রাতে কার্যকর হয় কাদের মোল্লার ফাঁসি। এ সময় তিনি চূড়ান্ত রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করতে পারবেন কি না, এ বিষয়ে বিতর্ক শুরু হয় আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে। এ কারণে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের সময় ১০ ডিসেম্বর রাতে নির্ধারিত হলেও মাত্র দুই ঘণ্টা আগে তাঁর আইনজীবীরা দুটি আবেদন করেন। একটিতে ওই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হয় এবং দ্বিতীয় আবেদনে রায় পুনর্বিবেচনা করে কাদের মোল্লার খালাসের আবেদন করা হয়। সর্বোচ্চ আদালত এসব আবেদন খারিজ করে দিলে কার্যকর করা হয়; কিন্তু রিভিউ গ্রহণ ও খালাসের আবেদন একত্রে খারিজ হওয়ায় এ ধরনের মামলায় রিভিউ আদৌ চলবে কি না, সে অস্পষ্টতা থেকে যায়। রিভিউয়ের এ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় গত বছরের ২৫ নভেম্বর। এতে যুদ্ধাপরাধের মামলায়ও সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করা যাবে বলে রায় প্রদান করেন আপিল বিভাগ। ফলে কামারুজ্জামানসহ অন্য সাজাপ্রাপ্তরাও তাঁদের দণ্ডাদেশের রিভিউয়ের আবেদন করার সুযোগ পাচ্ছেন। একই সঙ্গে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন সাজার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষও একই আবেদন করতে পারবে।