আদালত বললেন, বাচ্চাদের স্মার্টফোন দেয় কেন?
সন্তান ‘ম্যাচিউর’ না হওয়া পর্যন্ত তাদের হাতে স্মার্টফোন দেওয়া উচিত না বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।
আদালত বলেন, ‘অভিভাবকদেরও দায় দায়িত্ব আছে। বাচ্চাদের স্মার্টফোন দেয় কেন? ম্যাচিউর না হওয়া পর্যন্ত স্মার্টফোন দেওয়া উচিত না। সেটা ২২ ও ২৩ বছর হতে পারে।’
আজ সোমবার দুপুরে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি জে বি এম হাসানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া কথিত ব্লু হোয়েল গেমস মামলার শুনানিকালে এ মন্তব্য করেন।
শুনানি শেষে কথিত ব্লু হোয়েল গেম অবিলম্বে বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
নিজ বাসায় ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার হলিক্রসের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণার বাবা আইনজীবী সুব্রত বর্ধন গতকাল রোববার এ বিষয়ে রিট দায়ের করেন। রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী হুমায়ুন কবির কল্লোল।
আদালতের কার্যক্রমের শুরুতে হুমায়ূন কবির পল্লব বলেন, ‘ব্লু হোয়েল গেম নিয়ে একটি রিট আবেদন। জবাবে আদালত বলেন, পেপারে দেখছি।’
পল্লব বলেন, ‘তিন আইনজীবী রিট করেছেন। যার মধ্যে একজনের মেয়ে (স্বর্ণা) এ গেম খেলে আত্মহত্যা করেছে।’
এ সময় আদালত বলেন, ‘পেপারে এগুলো নিয়ে নিউজ আসছে। কার মেয়ে, বয়স কত, কোন স্কুলে পড়ে?’
এ সময় স্বর্ণার বাবা সুব্রত বর্ধন দাঁড়িয়ে বলেন, ‘মেয়ে ক্লাস এইটে পড়ে। ১৪ বছর বয়স। হলিক্রস স্কুলে। রোল নম্বর ছিল এক।’
এরপর সুব্রত বর্ধন নিহত স্বর্ণার একটি ছবিও আদালতকে দেখান।
আদালত বলেন, ‘ভালো স্কুল। মেধাবী মেয়ে। মেয়ে এগুলো করছে খেয়াল করেননি?’
জবাবে সুব্রত বলেন, ‘আমরা বিষয়টি বুঝতে পারিনি। ঘটনার আগে সে সবার সঙ্গে নবমীতেও গেছে। এরপর যে কী হয়ে গেল...।’
আদালত বলেন, ‘ভেরি স্যাড, ভেরি স্যাড। ইট ক্যান নট বি রিপেয়ার্ড। কবে আত্মহত্যা করেছে?’
জবাবে সুব্রত বলেন, ‘৫ অক্টোবর।’
এ সময় আইনজীবী পল্লব বলেন, ‘দিস ইজ অ্যান ইনসিডেন্ট।’
তখন আদালত একটি গানের লাইন বলেন, ‘যার চলে যায় সেই বোঝে হায় বিচ্ছেদের কী যন্ত্রণা।’
পল্লব বলেন, ‘ইন্টারনেটের ডার্ক ইফেক্ট হচ্ছে এগুলো। শুধু স্বর্ণাই নয়, এরপর রংপুরে এক আইনজীবীর মেয়ে ও বরিশালেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। সবাই সুইসাইডাল নোট দিয়ে গেছে।’
এ সময় স্বর্ণার সুসাইডাল নোট আদালতে উপস্থাপন করা হয়।
পল্লব বলেন, ‘নীল তিমি মরার সময় যেমন সমুদ্রের তীরে চলে আসে। তেমনি এটাও একই রকম। এ পারসেপশন থেকে সুসাইড নোট। ২০১৩ সালে এ গেম উদ্ভাবন করা হয়। রাশিয়ার এক যুবক এটি বের করে। পরবর্তীতে তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে দেওয়া হয়। তার সাত বছরের জেল হয়েছে। রাশিয়ার সংসদে এর বিরুদ্ধে আইন হয়েছে। এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে ৩০০ জনের মতো আত্মহত্যার খবর এসেছে। এর মধ্যে ১৫০ জন রাশিয়ায়। যে একবার ঢুকে সে আর বের হতে পারে না। এখানে ৫০ দিনের চ্যালেঞ্জ দেয়। যারা এ গেমে কিউরেটর বা মাস্টার, তারা টিনএজারদের ফেসবুকে সিলেক্ট করে। এরপর অ্যাপস পাঠায়। কেউ অ্যাকসেপ্ট করলে তারা তার সব কিছু জেনে নেয় এবং একটি পাসওয়ার্ড দেয়। তখন থেকে অনেক আনন্দ পায় ব্যবহারকারী। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মাস্টার ব্যবহারকারীকে কিছু কাজ দেয়। সেটাই সমস্যা। ভোর ৪টায় কবরস্থানে গিয়ে সেলফি দিতে বলে, রাত ৩টায় ছাদের কার্নিশে গিয়ে সেলফি দিতে বলে ইত্যাদি। এটার লাস্ট স্টেজ হলো আত্মহত্যা সংঘটন করা (কমিট টু সুসাইড)। গেম না খেললে থ্রেট দেওয়া হয়। দিস ইজ নট এ গেম। ইট ইজ ডেথ ট্র্যাপ।’
আদালত বলেন, ‘অ্যাবসোল্যুটলি। কারণ যারা এটা ব্যবহার করে তারাতো ম্যাচিউর না। বিটিআরসি কি এটা ব্লক করতে পারবে?’
পল্লব বলেন, ‘তারা করেনি। কেন করেনি সেটা জানি না।’ এরপর দৈনিক আমাদের সময়ের একটি সম্পাদকীয় পড়ে শোনান তিনি।
আদালত বলেন, ‘অভিভাবকদেরও দায়-দায়িত্ব আছে। বাচ্চাদের স্মার্টফোন দেয় কেন? ম্যাচিউর না হওয়া পর্যন্ত স্মার্টফোন দেওয়া উচিত না। সেটা ২২ ও ২৩ বছর হতে পারে।’
পল্লব বলেন, ‘এসব গেম রাতে খেলে। আর মোবাইল অপারেটররাও রাতে বিভিন্ন অফার প্যাকেজ দেয়। রাত হচ্ছে ঘুমানোর সময়। তারা কেন রাতে দেবে? তরুণদের জাগিয়ে রাখার জন্য এসব অফার দিচ্ছে।
শুধু এই গেমেই এ রকম আরো ১০টি গেম আছে। যেগুলো ক্ষতিকর।’
এরপর আদালত রিটের ওপর আদেশ দেন। আদেশে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া কথিত ব্লু হোয়েলসহ এ ধরনের সব গেম অবিলম্বে বন্ধের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি গেমগুলো বন্ধে কেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়।
স্বরাষ্ট্র সচিব, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিটিআরসি কর্তৃপক্ষ, পুলিশের মহাপরিদর্শক তথা আইজিপিসহ সংশ্লিষ্টদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
আদালত রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত মোবাইল অপারেটরদের রাত্রিকালীন বিশেষ ইন্টারনেট অফার বন্ধের নির্দেশ দেন।
এদিকে ঢাকায় স্বর্ণার ‘আত্মহত্যা’র নেপথ্যে ব্লু হোয়েলকে দায়ী করে খবর প্রকাশিত হওয়ায় এ নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন হয়। যদিও তার মৃত্যুর জন্য ব্লু হোয়েল গেমের সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ মেলেনি।
ব্লু হোয়েল ইন্টারনেটভিত্তিক একটি গেম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই গেম খেলে ১৩০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তবে কোনো ঘটনাতেই শতভাগ প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
রুশ তরুণ ফিলিপ বুদেকিন ২০১৩ সালে এই গেম আবিষ্কারের দাবি করেন। গত বছর আত্মহত্যায় প্ররোচনার দায়ে তাঁকে গ্রেপ্তারের পর কারাবন্দি করা হয়। তাঁর ভাষ্য, হতাশাগ্রস্ত তরুণদের বাঁচার অধিকার নেই। তাই সমাজ পরিষ্কারের অংশ হিসেবে তিনি এই গেম আবিষ্কার করেছেন।