সাক্ষাৎকার
সম্ভাবনার সামনে চ্যালেঞ্জ জমি আর মাটির উর্বরতা : রবসন
বিশ্বের খ্যাতনামা সুপারশপ ওয়ালমার্টে প্রথমবারের মতো রপ্তানি করা হয়েছে বাংলাদেশের আম। ওয়ালমার্টের যুক্তরাজ্যের বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে ব্রাজিল, পাকিস্তান ও ভারতের আমের পাশে জায়গা হয়েছে বাংলাদেশের হিমসাগর, ল্যাংড়া ও আম্রপালির। সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে উচ্চমূল্যের বাজারে রপ্তানির মাধ্যমে উচ্চ আয়ের। আর এ কাজটিকে সম্ভব করার পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে বিশ্বখাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও।
এসব বিষয়সহ বাংলাদেশের কৃষি নিয়ে এনটিভির সঙ্গে আলাপচারিতায় নানা কথা বললেন যুক্তরাজ্যের নাগরিক এফএওর বাংলাদেশ প্রতিনিধি মাইক রবসন। সংস্থাটির ঢাকা অফিসে বসে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। urgentPhoto
মাইক রবসন কৃষির সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় দুই দশকের। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-এফএওর সদর দপ্তর ইতালির রোমে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। কাজের সূত্রে দেখেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কৃষি। আড়াই বছর আগে এসেছেন বাংলাদেশে। ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম সব এলাকায়। এ দেশের কৃষক ও কৃষির সঙ্গে এরই মধ্যেই গড়ে উঠেছে যার নিবিড় সম্পর্ক। তার সঙ্গে কথায় কথায় উঠে আসে এ দেশের কৃষির অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ।
এনটিভি : কীভাবে সম্ভব হলো ওয়ালমার্টে এ দেশের আম রপ্তানি?
মাইক রবসন : দেখুন, দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশ আম রপ্তানি করে আসছে, তবে তা বিদেশে সেখানকার কমিনিউটি মার্কেটগুলোতে। সুপারশপে বা উচ্চমূল্যের বাজারে আম রপ্তানির জন্য উৎপাদনের আন্তর্জাতিক মান ও আমের গুণগত মান না থাকার কারণেই এমনটা হচ্ছে। আমরা এ বিষয়টিতে নজর দিয়েছি। হর্টেক্স ফাউন্ডেশন, সরকারের কৃষি অধিদপ্তরকে সহযোগিতা দিয়েছি আন্তর্জাতিক মানের উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য। এ বছর সীমিত পরিসরে সেটা হয়েছে এবং ওয়ালমার্টের মতো ব্র্যান্ড শপে আম রপ্তানি করতে পেরেছে বাংলাদেশ।
এনটিভি : এ ধারা অব্যাহত রাখা এবং বাজার সম্প্রসারণের জন্য তাহলে এখন করণীয় কী?
মাইক রবসন : আমরা শুধুমাত্র পথ দেখিয়েছি যে এ দেশের পক্ষে সম্ভব। এখন কাজটি করতে হবে মূলত বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের। সরকার হয়তো দিকনির্দেশনা বা কারিগরি সহায়তা দিতে পারে। কিন্তু সরকার তো আর ব্যবসা করবে না। কাজেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উচ্চমূল্যের বাজারে রপ্তানির জন্য ব্যবসায়ীদেরই কাজ করতে হবে। আমি মনে করি সেটি বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা পারবে।
এনটিভি : আম ছাড়া অন্যান্য ফল এবং সবজি রপ্তানির কী অবস্থা দেখছেন?
মাইক রবসন : বাংলাদেশে একটি বিষয় খুব লক্ষণীয়, ফল এবং সবজি যখন বাজারে আসতে শুরু করে তখন সব একসঙ্গে আসা শুরু করে। যে কারণে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পান না। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে রপ্তানির সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে। আমি আগেই বলেছি, এর জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক মানের উৎপাদন। সেটি করতে পারলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে বাংলাদেশ। এখন যে রপ্তানি হচ্ছে না তা নয়, তবে তা নিম্নমূল্যের বাজারে। ফলে সেখানেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক।
এনটিভি : ফল সবজি নিয়ে তো কথা হলো, সামগ্রিকভাবে এ দেশের কৃষিকে কেমন দেখছেন আড়াই বছরে?
মাইক রবসন : এ দেশের কৃষির উত্থান সত্যিই আশাবাদী হওয়ার মতো। একটি উদাহরণ দিয়ে বলি, আমার এক সহকর্মী দুই দশক আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন। উত্তরাঞ্চল সফরের সময় তিনি দেখলেন, রাস্তার দুই পাশে অনেক জায়গায় ধু ধু বালুচর, সবুজ নেই, অনেক জমিতে শস্যগুলোও রোগাক্রান্ত। কিন্তু এখন? আপনিই বলুন, সে দৃশ্য কি দেখতে পান? খাদ্যশস্য উৎপাদনে এখন তো বেশ স্বয়ংসম্পূর্ণই বলা যায়। কিন্তু কৃষি খাতে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
কৃষিতে প্রযুক্তির কোনো বিকল্প নেই। চীন থেকে আনা দুই চাকার ট্রাক্টর এ দেশের কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। কৃষিকে এগিয়ে যেতে হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। অনেক জায়গায় দেখেছি কৃষিকে শ্রমিকের সংকট, শ্রমিকদের অনেক টাকা দিতে হয়। কারণ গার্মেন্টস বা শহরে শ্রম দিতে অনেকেই গ্রাম ছাড়ছেন। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লে এ সংকট কিছুটা কমবে।
কৃষকদের যেমন ন্যায্যমূল্য দিতে হবে তেমনি ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার দিকেও নজর দিতে হবে। দারিদ্র্য নিরসন ও শিশুর পুষ্টির সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ খুব দ্রুত অগ্রগতি করছে। এটি প্রশংসার দাবিদার।
এনটিভি : কৃষি খাতে চ্যালেঞ্জের কথা বলছিলেন, কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে এ দেশের কৃষির সামনে?
মাইক রবসন : আমার কাছে মনে হয় কৃষিজমি রক্ষা করাটা এখন এ দেশের কৃষির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ দেশের খামারের আয়তন খুব ছোট। তার ওপর বিভিন্ন হিসাবে বলা হচ্ছে যে প্রতিবছর এক শতাংশ করে জমি কমছে। কিন্তু আমার ধারণা এটি আরো বেশি, তিন থেকে চার শতাংশ হবে। কৃষিজমি রক্ষার জন্য এ দেশে অনেক আইন আছে কিন্তু সেই আইনগুলোর বাস্তবায়ন খুব একটা লক্ষ করা যাচ্ছে না। জমি হারিয়ে গেলে কিন্তু আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তখন কৃষি কিন্তু বড় একটা বিপদের মধ্যে পড়তে পারে।
এনটিভি : সেটি কী ধরনের বিপদ?
মাইক রবসন : এখনই এ দেশে শস্য নিবিড়তা ১৯০ শতাংশ। অর্থাৎ একটা জমি থেকে বছরে দুবার ফসল উৎপাদন করা হচ্ছে। আমি লালমনিরহাট গিয়েছিলাম। সেখানকার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি সেখানে শস্য নিবিড়তা ২৩০ শতাংশ। এটি ভালো, কিন্তু এর বিপরীতে আশঙ্কাও আছে। জমি কমে গেলে শস্য নিবিড়তা আরো বাড়বে। জমির ওপর চাপ বাড়ার ফলে জমির উর্বরতা কমতে শুরু হবে। এখনই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাটির বিভিন্ন পুষ্টি উপদানে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে অতিরিক্ত ফলনের জোগান দিতে গিয়ে মাটির জৈব উপাদান কমতে শুরু করেছে বিভিন্ন জায়গায়। অন্যান্য পুষ্টি উপাদান যেমন নাইট্রোজেন, পটাশিয়ামসহ আরো অনেক পুষ্টি উপাদান কমছে বিভিন্ন জায়গায়।
এনটিভি : প্রতিকারের উপায় কী?
মাইক রবসন : প্রতিকারের জায়গাটিও উদ্বেগজনক। বাড়তি ফলনের জন্য মাটির পুষ্টি উপাদানের জোগান দিতে সার বা অন্য যেসব উপকরণ যোগ করা হচ্ছে তাও অনেক ক্ষেত্র কাজ করছে না। অর্থাৎ মাটি সাড়া দিচ্ছে না। হতে পারে সেসব উপকরণে ভেজাল রয়েছে। ঢাকার মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের সঙ্গে আমরা কাজ করেছি। সেখানে যে অভিজ্ঞতাটি হয়েছে তা হলো, এখানকার অনেক সারেই ভেজাল পাওয়া যাচ্ছে। অন্যান্য রাসায়নিকের ক্ষেত্রেও তা হয়তো ঘটছে। আমার কাছে সবকিছুর তথ্য প্রমাণ নেই। ফলে এসব প্রয়োগে যা হচ্ছে তা হলো মাটির গুণাগুণ নষ্ট হচ্ছে। মাটির পুষ্টি উপাদানে আরো ঘাটতি দেখা দিচ্ছে, বিষাক্ত হচ্ছে মাটি। মাটির স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। মাটির লবণাক্ততাও দিন দিন সমস্যার আকার ধারণ করছে। লবণাক্ত মাটির পরিমাণ বাড়ছে। উপকূলীয় এলাকাজুড়ে এ সমস্যার মাত্রা বাড়ছে। প্রতিকারের জন্য এখন থেকেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এরই মধ্যে অবশ্য লবণাক্ততা সহিষ্ণু অনেক জাতের ফসল উদ্ভাবন করেছেন বিজ্ঞানীরা। এর সংখ্যাটা আরো বাড়াতে হবে।
এনটিভি : তাহলে এর জন্য দায়ী কারা? কৃষকদের দায় কতটুকু?
মাইক রবসন : কারা দায়ী তা দেখার জন্য সরকারের দায়িত্বশীল বিভাগ রয়েছে। যাঁরা ভেজাল সার প্রস্তুত করছেন বা সরবরাহ করছেন, তাঁদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে কৃষকরা যেন প্রতারিত না হয়। কৃষকদের বিজ্ঞানের দিকে নজর দিতে হবে। শোনা কথায় বিশ্বাস না করে বিজ্ঞানীরা কী বলছেন সেটাকে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ বিজ্ঞানীরা প্রমাণ দিয়ে কথা বলেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কৃষকদের আশপাশে অনেকেই বলেন, এটা হয়েছে, ওটা হয়েছে এরকম নানা কথা। এসবে বিশ্বাস করবেন না। কৃষকদের বলব আপনারা জানুন বিজ্ঞানীরা কী বলছেন? কারণ তারা প্রমাণ দিয়ে কথা বলেন। কেউ আপনাকে যদি বলে ভূগর্ভস্থ পানি স্তর এখানে অনেক নিচে নেমে গেছে তাহলে তাকে জিজ্ঞাস করবেন বিজ্ঞানীরা সেটি বলেছেন কি না এবং এতে করণীয় কী।
প্রশ্ন : ভূগর্ভস্থ পানির বিষয়ে আপনার মতামত কী?
মাইক রবসন : দেখুন একটু আগেই বলেছিলাম যে এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা কী বলেন তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমি তো এ বিষয়ে বিজ্ঞানী নই, আর আমার কাছে এই মুহূর্তে কোনো তথ্যও নেই। কাজেই ঠিক কী ঘটছে তা বলা মুশকিল। আর ভূগর্ভস্থ পানির বিষয়টি খুবই জটিল প্রক্রিয়া। এই অঙ্ক মেলানো খুব কঠিন। কারণ পানির স্তর কতটুকু নেমেছে, ওপরের পানি দিয়ে আবার তা কতটুকু পূর্ণ হচ্ছে, পঞ্চাশ বা একশো বছর আগে কেমন ছিল ইত্যাদি নানা প্রশ্ন আছে। তবে ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে পারলে ভালো। তাতে ঝুঁকি কমবে।
এনটিভি : তাহলে কৃষির এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কী করা উচিত?
মাইক রবসন : আমি সমস্যাগুলোর সঙ্গে কিন্তু সমাধানের দিকগুলোও তুলে ধরেছি। কৃষি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর যেমন দায়িত্ব রয়েছে তেমনি কৃষকদেরও বিজ্ঞানমনস্ক হতে হবে। বৈজ্ঞানিক চাষাবাদ ও উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে পারি, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কৃষিতে কী হচ্ছে তা এ দেশের মানুষ দেখছে। সেখানকার অভিজ্ঞতা ও এখানকার বাস্তবতা বিবেচনা করে বাংলাদেশও কৃষির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে সক্ষম হবে বলে প্রত্যাশা করেন মাইক রবসন। আমার অভিজ্ঞতা বলছে, ভালো কাঠামোতেই আছে বাংলাদেশের কৃষি। খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি অনেক দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। তবে আপাতত এ বিষয়ে কিছুটা স্বস্তিতেই আছে বাংলাদেশ। সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিলে অতীতের অনেক ধারণার মতো ভবিষ্যতের অনেক আশঙ্কাও ভুল প্রমাণিত হবে।
সাক্ষাৎকার শেষে বিদায় জানানোর সময় এ দেশের কৃষকদের প্রতি অভিনন্দন জানাতে ভোলেননি বাংলাদেশের কৃষির অন্যতম সহযোগী জাতিসংঘের এ সংস্থাটির বাংলাদেশ প্রধান।