‘ক্যানসার মানে মৃত্যু নয়, মানুষ ক্যানসারজয়ী’
‘ক্যানসার হ্যাজ নো অ্যানসার’ যুগের শেষ হয়েছে। এখন চলছে ‘ক্যানসার মানে মৃত্যু নয়’ এর যুগ। এমন প্রত্যয় ব্যক্ত করে বিনা খরচে একদল ভারতীয় চিকিৎসক সাতক্ষীরায় ক্যানসার নির্ণয় সেবা দিয়ে গেলেন। সেবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা সতর্ক করে গেলেন যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসা পেলে ক্যানসার নিরাময় সম্ভব। এ জন্য চাই ক্যানসার-সচেতনতা।
আজ শনিবার দিনভর সাতক্ষীরা শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজন করা হয় ক্যানসার রোগসচেতনতা ও নির্ণয় শিবিরের। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত ক্যানসার রিসার্চ অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার সেন্টার এই সেবা দেয়। সাতক্ষীরার চার শতাধিক নারী-পুরুষ এই সেবা নেন। চিকিৎসকরা তাঁদের সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে বলেছেন, নিয়মিত চিকিৎসক দেখালে ক্যানসার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। এতে আতঙ্কের কিছু নেই। মানুষ এখন ক্যানসারজয়ী।
বারাসাত সেন্টারের ডা. প্রবীর বিজয় করের নেতৃত্বে আট সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল রোগীদের পরীক্ষা করেন এবং তাঁদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন।
সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের উদ্যোগে দিনব্যাপী এই শিবিরের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। প্রেসক্লাব আহ্বান জানালে আগামীতে তাঁরা আবারও সেবা দিতে বাংলাদেশে আসবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন ভারতীয় চিকিৎসকরা।
সকালে ক্যানসার সচেতনতাবিষয়ক এক সমাবেশে ভারতীয় চিকিৎসক ড. রণজিৎ মণ্ডল বলেন, সচেতন না হলে কখন কার দেহে ক্যানাসর বাসা বাঁধে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। মানুষ এখন ক্যানসারজয়ী উল্লেখ করে তিনি বলেন, সময়মতো সঠিক চিকিৎসা দেওয়া হলে ক্যানসার ভালো হয়ে যায়।
পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে ক্যানসারে মৃত্যুহার অপেক্ষাকৃত কম উল্লেখ করে রণজিৎ মণ্ডল বলেন, ক্যানসারের প্রথম পর্যায়ে চিকিৎসা দিতে পারলেই শতকরা ৯০ ভাগ রোগী সুস্থ হয়ে যায়। এ ছাড়া প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে শতকরা ৪০ ভাগ মানুষের ক্যানসার আটকানো সম্ভব বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
নিয়মিত ব্যায়াম, পরিমিত খাদ্য গ্রহণ, মাদক পরিত্যাগের পাশাপাশি গ্রিলড মাংস, টিনজাত মাছ, শুঁটকি মাছ প্রত্যাখ্যান করে ক্যানসার রোধ করা যায় বলেও জানান রণজিৎ মণ্ডল।
সমাবেশে ডা. পি বি কর জানান, দেহে ক্যানসার বাসা বাঁধার পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলে আর কিছুই করার থাকে না। ক্যানসার কোনো বয়স মানে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, নিউমোনিয়া, জন্মের সময় থেকে শিশুর অণ্ডকোষ ভেতরে থেকে যাওয়া, থাইওরয়েড গ্লান্ড, চেস্ট, প্রোস্টেড গ্লান্ড, জরায়ুসহ নানা স্থানে ক্যানসার বিস্তার লাভ করতে পারে। মুখ, মুখগহ্বর, জরায়ু, নারী ও পুরুষের ব্রেস্ট, ফুসফুসের শতকরা ৭০ ভাগ ক্যানসার হয়ে থাকে। আগে থেকে ক্যানসার প্রতিরোধে সচেতন হলে এই রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সার্জারি, রেডিয়েশন ও কেমোথেরাপির মাধ্যমে ৫০ শতাংশ রোগীকে ভালো করে তোলা যায় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
পি বি কর বলেন, বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্যানসার রোগপ্রবণতা বহুলাংশে কম। তবে এসব জনগোষ্ঠী শিক্ষিত না হওয়ায় তারা স্বাস্থ্যসচেতন নন। এ জন্য ক্যানসার তাদের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। জীবনযাপন পরিবর্তন করে তামাক গ্রহণ না করলে ক্যানসারের মতো ব্যাধি থেকে দূরে থাকা যায়।
এ প্রসঙ্গে পি বি কর বলেন, ১৮ বছরের আগে কোনো বিয়ে নয়, এক থেকে দুই সন্তানের বেশি সন্তান গ্রহণ নয়, পিরিয়ডের সময় স্বাস্থ্যসম্মত প্যাড ব্যবহার করতে হবে।
এক পরিসংখ্যানের বরাত দিয়ে ডা. পি বি কর বলেন, বাংলাদেশে খৈনি, তামাক, গুল, বিড়ি-সিগারেট খাওয়ার প্রবণতা বেশি থাকায় এসব ব্যবহারকারীদের শতকরা ২০ জন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। জিহ্বায় ক্ষত ও দাঁত দিয়ে রক্ত পড়া দীর্ঘদিনের হলে তা কোনো সুখবর বয়ে আনে না। চীন ও জাপানের মানুষ শুঁটকি মাছ বেশি খায় বলে তাদের খাদ্যনালিতে ক্যানসার পাওয়া যায়।
আর্সেনিক ক্যানসারের অন্যতম উৎস মন্তব্য করে পি বি কর বলেন, বাংলাদেশ এই প্রবণতায় প্রথমে রয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে ভারত। জল, চাল, ডাল এমনকি সবজিতেও আর্সেনিকের উপস্থিতি আছে বলে সতর্ক করে দেন তিনি। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের পুরুষাঙ্গে ক্যানসার প্রবণতা বেশি থাকলেও মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকদের ক্ষেত্রে তা কম। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পুরুষাঙ্গের মাথায় চামড়া থাকায় এর ভেতরের অংশ অপরিচ্ছন্নতার জন্য ক্যানসার দানা বাঁধার সুযোগ পায়।
চিকিৎসকদলটির অন্য সদস্যরা হলেন জন ম্যাথিউ, গৌতম ঘোষ, অমিতাভ রায়, টিকে দাস, হিনা কারিয়া, পি কে দাস ও গৌতম মিস্ত্রি। তাঁদের সহায়তা করেন মৃণাল কান্তি দে, সুব্রত বিশ্বাস, শম্ভু সরকার, মানব দাস, মকিদ আহমেদ, অনুপ কুমার চক্রবর্তী, শুভজিৎ নন্দী, সুনীতি দাস, পুষ্প হালদার, সুবর্ণা মজুমদার, মাধুরী মণ্ডল, শর্মিষ্ঠা দাস ঘোষ, স্বপ্না মণ্ডল, মালবিকা পাল, মনীষা রায় চৌধুরী ও শিউলি দাস সেন।
শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে আজ প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এহতেশামুল হক। সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সভাপতি অধ্যাপক আবু আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন বিশিষ্ট সমাজসেবক শেখ আজহার হোসেন, সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ আবদুল সাদী, প্রেসক্লাব সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান উজ্জ্বল, সাংবাদিক ড. দিলীপ কুমার দেব প্রমুখ।
বক্তারা মানবতার এই সেবার জন্য ভারতীয় চিকিৎসকদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ভারত ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে মিত্র বাহিনীর ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশের জনগণকে কৃতজ্ঞ করেছে। এবার তারা স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আমাদের বন্ধুত্বকে আরো অটুট করে রাখল। তাঁরা বারাসাত ক্যানসার সেন্টারের এই মহতী উদ্যাগকে স্বাগত জানান।
কাল রোববার চিকিৎসকদলটি খুলনা ও সোমবার বাগেরহাটে একই সেবা দেবে বলে জানিয়েছে। সন্ধ্যায় চিকিৎসকদলটি খুলনার উদ্দেশে সাতক্ষীরা ত্যাগ করে।