নাশকতার আশঙ্কায় হাসান সরকারের বাড়ি তল্লাশির দাবি জাহাঙ্গীরের

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের এবারের নির্বাচনের ভোট গ্রহণের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থী ও তাঁদের কর্মী-সমর্থকসহ সবার মধ্যে বাড়ছে উত্তাপ ও উত্তেজনা। এ উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে মেয়র পদে প্রধান দুই প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী মো. জাহাঙ্গীর আলম ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার এবং তাঁদের কর্মী-সমর্থকসহ নির্বাচনী এলাকায়।
আনুষ্ঠানিক প্রচারণা বন্ধ থাকলেও কৌশলে কর্মী-সমর্থকদের ধরে রাখতে নীরব প্রচারণায় রয়েছেন প্রধান দুই দলের মেয়র প্রার্থীরা। মূলত ইফতার মাহফিল ও মসজিদ-মাদ্রাসাকেন্দ্রিক প্রচার-প্রচারণায় তৎপরতায় রয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম ও বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার। কৌশলে নির্বাচনী প্রচারণকালে দুই প্রার্থীই জড়িয়ে পড়েছেন বাক যুদ্ধে।
আজ সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে মেয়র পদপ্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম দাবি করেন, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের সঙ্গে জেএমবি ও জামায়াতে ইসলামীর যোগাযোগ রয়েছে। তাঁর বাসায় অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বিএনপির প্রার্থী ও তাঁর কর্মী-সমর্থকরা বোমা মেরে নাশকতা করতে পারে- এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে সরকারকে এ জন্য গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোসহ বিএনপি-জামায়াত নেতাদের বাড়ি তল্লাশির দাবি জানান জাহাঙ্গীর।
অপর দিকে, এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে হাসান সরকার বলছেন, আওয়ামী লীগ প্রার্থী নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করছেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বক্তব্যে সুগভীর ষড়যন্ত্র নিহিত রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
সোমবার দুপুরে মহানগরের ছয়দানা এলাকায় নিজ বাসায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বিএনপি মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার নানাভাবে উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে জেএমবি ও জামায়াতে ইসলামীর যোগাযোগ রয়েছে। সম্প্রতি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের মেয়র পদপ্রার্থী বিভিন্ন ইফতার পার্টিতে বলেছেন, ভোট ডাকাতদের গাজীপুরে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হবে। আর এজন্য বোমা ও বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন। এতে আশঙ্কা করা হচ্ছে হাসান উদ্দিন সরকারের বাসায় অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ থাকতে পারে। অতীতে বিএনপি ও তার জোট সড়কে যানবাহনে, বিপণিবিতানে বোমা হামলা করেছে। উনি এর আগে যখনই নির্বাচন করেছেন, তখনই এখানে রক্তপাত হয়েছে, মানুষ খুন হয়েছে। তারা জঙ্গিদের সঙ্গে জড়িত, জামায়াতের সঙ্গে জড়িত। তারা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তৎপর রয়েছে।
তাই বিএনপির প্রার্থী ও তাঁর কর্মী-সমর্থকরা বোমা মেরে নির্বাচনে নাশকতা করতে পারে- এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে সরকারকে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোসহ বিএনপির প্রার্থী এবং তাঁর সঙ্গে যারা চলাফেরা করে তাদের বাড়ি তল্লাশির দাবি করেছেন জাহাঙ্গীর।
জাহাঙ্গীর আলম ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, হাসান উদ্দিন সরকার ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হয়ে লাঙল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ওই নির্বাচনে তাঁর পক্ষে জোরপূর্বক লাঙল মার্কায় সিল মারতে গিয়ে সন্ত্রাসী শফি খুন হয়। ১৯৮৮ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনে জালভোটের মাধ্যমে হাসান উদ্দিন সরকার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি গাজীপুর সিটি করপোরেশনের এবারের নির্বাচনেও ভোটারদের হুমকি দিচ্ছেন ভোটকেন্দ্রে না আসার জন্য। সে সময়কার জাতীয় পার্টির আদলে তিনি এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছেন।
জাহাঙ্গীর আলম সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে আসন্ন সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন করার আহ্বান জানান।
আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম আরো বলেন, হাসান উদ্দিন সরকার আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার সেল গঠনের অভিযোগ করেছেন তা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। মিথ্যাচার ও উসকানিমূলক বক্তব্য পরিহারের আহ্বান জানান জাহাঙ্গীর আলম।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের নির্বাচনী প্রচারণা বিষয়টি সঠিক নয় বলে জানিয়ে জাহাঙ্গীর বলেন, তাঁরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় সাধারণ মানুষ এবং নেতাকর্মীদের নিয়ে ইফতার করেন। এটা তাদের ধর্মীয় অধিকার।
সংবাদ সম্মেলনে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সহসভাপতি ও গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য অ্যাডভোকেট শফিকুল ইসলাম বাবুল, উপদেষ্টা মো. শফিকুল আলম, সহসভাপতি আবদুর রউফ নয়ন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ মণ্ডল, এস এম মোকসেদ আলম, সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ মহিউদ্দিন মহি, কাজী ইলিয়াস আহমদ, মো. মজিবুর রহমান, সহ-দপ্তর সম্পাদক মো. মাজহারুল ইসলাম, মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী সেলিনা ইউনুস, সাধারণ সম্পাদক ফাহিমা আক্তার হুসনা, কেন্দ্রীয় নেত্রী নীলিমা আক্তার লিলি প্রমুখ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
হাসান সরকার যা বললেন
অপরদিকে ধানের শীষ প্রতীকের মেয়র পদপ্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, সরকারি দলের প্রার্থী উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে নির্বাচন বানচাল করার পাঁয়তারা করছেন। তিনি সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিষয়টি দেখার অনুরোধ জানান। এ সময় সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে প্রার্থী নিজের এবং কর্মী-সমর্থকদের নিরাপত্তা দাবি করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকের মিডিয়া সেলের প্রধান বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ডা. মাজহারুল আলম। তিনি বলেছেন, পবিত্র রমজান মাসে গাজীপুর নগরীতে চলমান শান্তিপূর্ণ পরিবেশে জাহাঙ্গীর আলম আকস্মিক সংবাদ সম্মেলন ডেকে বিএনপি প্রার্থীর সমালোচনার আয়োজন করার মধ্যে সুগভীর ষড়যন্ত্র নিহিত রয়েছে। প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসান উদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীর আলমের মুখে সমালোচনা মানায় না। যার আকস্মিক রাজনৈতিক উত্থানের পেছনে ঝুট-গুলি-বোমা-জেএমবিসহ বহু বিতর্ক জড়িত তাঁর মুখে অন্যের সমালোচনা বেমানান ও লজ্জাকর।
ডা. মাজহার বলেন, জেএমবির সঙ্গে কার সম্পৃক্ততা আছে গাজীপুরবাসী তা ভালো করেই জানে। তবে আমরা বিগত দিনে জেএমবি সম্পৃক্ততাসহ বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার ঘটনায় জাহাঙ্গীরকে নিয়ে গণমাধ্যমে বহু সংবাদ প্রকাশ হতে দেখেছি। তিনি বলেন, নগরপিতা হিসেবে কাকে মানায় তা জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে।
হাসান সরকারের মিডিয়া সেলের প্রধান বলেন, হাসান উদ্দিন সরকারের রাজনৈতিক জীবনের বয়স যত জাহাঙ্গীরের বয়সও তত নয়। বিগত ১৯৮৬ সালে জাহাঙ্গীর আলম যখন শিশু, হাসান উদ্দিন সরকার তখন একজন অভিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত জনপ্রতিনিধি। গাজীপুর জেলায় শিক্ষা ও অবকাঠামো খাতে হাসান উদ্দিন সরকারের চেয়ে বেশি অবদান আজ পর্যন্ত কেউ রাখতে পারেননি। তিনি অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন। হাসান সরকার যখন টঙ্গী পৌরসভার চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন গোটা টঙ্গীতে রাস্তা ছিল মাত্র ১৩টি, আর তিনি দায়িত্ব হস্তান্তরকালে ৩৬৫টি রাস্তা নির্মাণ করে রেখে যান। বর্তমানে যত রাস্তা আছে তা হাসান উদ্দিন সরকারের অবদান। আওয়ামী লীগ যে উন্নয়নের কথা বলছে এগুলো তাদের নিজেদের আখের গোছানোর উন্নয়ন। বর্তমান মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নানকে কারাগারে বন্দি রেখে আওয়ামী লীগ গাজীপুর সিটিতে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তারা রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন অবকাঠামো সংস্কারের নামে জনগণের ট্যাক্সের টাকা লুটপাট করেছে। আবারও তারা লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করতে চায়। যারা ব্যাংক লুট করে তাদের কাছে সিটি করপোরেশনসহ জনগণের কোনো সম্পদই নিরাপদ নয়।
বিএনপির ইফতার মাহফিল
এদিকে সোমবার গাজীপুর সিটি করপোরেশনের পূবাইল বিন্দানে স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর উদ্যোগে আয়োজিত এক ইফতার মাহফিলে শরিক হন বিএনপি মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার। বিন্দান বিএনপির সভাপতি হারুন সরকারের সভাপতিত্বে ও আনোয়ার মোড়লের সঞ্চালনায় এ ইফতার মাহফিলে আরো উপস্থিত ছিলেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক মিলন, বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, সহসাংগঠনিক সম্পাদক শহীদুল ইসলাম বাবুল, সহশ্রম বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির খান, সহ-স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বাচ্চু, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল, রিয়াজুল হান্নান শাহ, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ডা. মাজহারুল আলম, জেলা বিএনপির সহসভাপতি হুমায়ুন মাস্টার ও মীর হালিমুজ্জামান ননী, যুগ্ম সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন সবুজসহ বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতারা ইফতার মাহফিলে শরিক হন।
নির্বাচন কমিশনের পুনরায় ঘোষিত তারিখ অনুযায়ী আগামী ২৬ জুন গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৬ জন।