পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে মৌলভীবাজারে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত
কয়েক দিনের ভারি বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মৌলভীবাজারের মনু ও ধলাই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের ১৩টি স্থান ভেঙে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
আজ বুধবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, এখানকার শতাধিক গ্রাম তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি। নদীর পানির উচ্চতা এখন বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
কুলাউড়া উপজেলায় টিলাগাঁও, শরিফপুরসহ হাজিপুর ইউনিয়নজুড়ে প্রতিরক্ষা বাঁধে পাঁচটি ভাঙন দেখা দিয়েছে।
এ ছাড়া কমলগঞ্জ উপজেলার কমলগঞ্জ পৌর এলাকা, মুন্সীবাজার ইউনিয়ন, আদমপুর ও মাধবপুর ইউনিয়নে প্রতিরক্ষা বাঁধের জায়গায় আটটি ভাঙন দিয়ে প্রবেশ করছে বন্যার পানি।
ফলে তলিয়ে গেছে এসব এলাকার বাড়িঘর, রাস্তা ঘাটসহ ফসলি জমি। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ওই এলাকার লক্ষাধিক মানুষ। বাড়িঘর তলিয়ে যাওয়ায় কেউ কেউ নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন।
এদিকে, বন্যার পানিতে নিমজ্জিত থাকায় শমসেরনগর চাতলাপুর ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট সড়ক, মুন্সীবাজার-কমলগঞ্জ-কুরমা সড়ক ও শমশেরনগর-কুলাউড়া সড়কের একাংশ তলিয়ে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
এসব সড়কে কোথাও কোথাও বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে দেড় থেকে তিন ফুট রাস্তা। এতে চলাচলে দেখা দিয়েছে চরম দুর্ভোগ।
এদিকে মনু নদীর পানির উচ্চতা বেড়ে গিয়ে গতকাল মঙ্গলবার রাতে কুলাউড়ার শরীফপুর ইউনিয়নের বাঘজুর ও তেলিবিল গ্রাম এলাকায় পাহাড়ি ঢল প্রবেশ করে। অন্যদিকে, আজ সকালে চাতলাপুর সেতুর উত্তরপাশে ও দুপুরে হাজিপুর ইউনিয়নের মিঞারপাড়া এলাকায় নদী ভাঙনের ফলে তলিয়ে যায় কয়েকশ বাড়ি।
এরই মধ্যে এখানকার ১৫টি গ্রামের প্রায় চার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার কবলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে কুলাউড়া-শমশেরনগর ও বাংলাদেশ-ভারতের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা।
মৌলভীবাজার-২ আসনের সাংসদ আব্দুল মতিন, কুলাউড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) চৌধুরী মো. গোলাম রাব্বি শরীফপুর ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
তাঁরা জানিয়েছেন, এ ইউনিয়নের পানিবন্দি লোকজনের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ প্রদানসহ আর্থিক সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া পানি কমলে ও জরুরি ভিত্তিতে সড়ক যোগাযোগ চালু রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে কাজ করা হবে।
শরীফপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. জনাব আলী বলেন, মঙ্গলবার শবে কদরের রাত সাড়ে ৮টায় আমতলা বিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন মনু প্রতিরক্ষা বাঁধে ভাঙন শুরু হলে গ্রামবাসী ও বিজিবি সদস্যরা মিলে শতাধিক বস্তা বালু দিয়ে এটাকে রক্ষা করেন। তবে রাত আড়াইটায় বাঘজুর ও তেলিবিল গ্রাম এলাকার প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে ঢলের পানি গ্রামে ঢুকতে শুরু করে। এ পানি বাড়িঘরসহ ফসলি জমি তলিয়ে দিয়েছে। বাঘজুর, তেলিবিল, চাঁনপুর, খাম্বারঘাট, শরীফপুর, বটতলা, সঞ্জরপুর গ্রামের দুই হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
এদিকে, ভানুগাছ বাজার সংলগ্ন রামপাশা, আলেপুর এলাকায় প্রতিরক্ষা বাঁধের আরো তিনটি স্থান ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
আজ দুপুরে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কমলগঞ্জ পৌরসভা ও মুন্সীবাজার ইউনিয়নের ১২৫টি পানিবন্দি পরিবারের মধ্যে জরুরিভিত্তিতে ১০ কেজি করে জিআর চাল বিতরণ করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত সোমবার ও মঙ্গলবার দুই দিন দুই রাত অবিরাম বৃষ্টিপাতে ধলাই নদীর তীরবর্তী কমলগঞ্জ পৌরসভার বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
এ ছাড়া করিমপুর, মুন্সীবাজার ইউনিয়নের সুরানন্দপুর, রহিমপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর, আদমপুর ইউনিয়নের কেওয়ালীঘাট, ঘোড়ামারা, মাধবপুর ইউনিয়নের কাটাবিল, ইসলামপুর ইউনিয়নের শ্রীপুর সংলগ্ন ধলাই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের পুরোনো ও নতুন ভাঙন দিয়ে পানি ঢুকে পড়েছে।
ফলে বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে ছয়টি ইউনিয়নের করিমপুর, ঘোড়ামারা, বাসুদেবপুর, সুরানন্দপুর, বনগাঁও, ধলাইরপার, শ্রীপুর, ঘোড়ামারা, হীরামতি, যুদ্ধাপুর, নাগড়া, গোপালনগর, নাজাতকোনা, কেওয়ালীঘাট, কান্দিগাঁও, হোমেরজানসহ ৫০টি গ্রাম। এসব গ্রামের ফসলি জমিগুলোও পানিতে তলিয়ে গেছে।
টানা বর্ষণে ধলাই নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কমলগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মো. জুয়েল আহমদ বলেন, ‘করিমপুর এলাকায় নদীর ভাঙন দিয়ে পানি প্রবেশ করায় পৌর এলাকার গোপালনগর, করিমপুর, যুদ্ধাপুর ও নাগড়া গ্রামের তিনশ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এসব এলাকায় প্রাথমিকভাবে কিছু ত্রাণসামগ্রী বিতরণ চলছে।’
মুন্সীবাজার ইউপি চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মোতালিব তরফদার জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতির কারণে যথাসময়ে ধলাই নদীর ভাঙন মেরামত না করায় এবার বন্যা হয়েছে। ধলাই নদীর ভাঙা বাঁধ মেরামতের জন্য জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে তিনি সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান।
আদমপুর ইউপি চেয়ারম্যান আবদাল হোসেন জানান, নদীর একাধিক স্থানে ভাঙনের ফলে ঘোড়ামারা, খেওয়ানিঘাট, কান্দিগাঁও, বন্দরগাঁও, মধ্যভাগ, হেরেঙ্গাবাজার গ্রামের প্রায় আড়াই হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নদীর পানি এখনো বাড়ছে বলেও তিনি জানান।
কমলগঞ্জের ইউএনও মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, ‘করিমপুর এলাকার প্রায় দেড়শ ফুট ভাঙন পরিদর্শন করেছি। এ ছাড়া পুরোনো কয়েকটি ভাঙন দিয়ে পানি বের হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন এ দিকে সতর্কতার সঙ্গে নজরদারি করছে। আপাতত কয়েকটি এলাকায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে।’
জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে তাৎক্ষণিক বিতরণের জন্য কুলাউড়া উপজেলায় ৫০ টন, কমলগঞ্জ উপজেলায় ৪৫ টন, রাজনগরে ১০ টন ও শ্রীমঙ্গলে পাঁচ টন চাল বরাদ্দের প্রক্রিয়া চলছে।
এ ছাড়া কুলাউড়া ও কমলগঞ্জে এক লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে বলেও জেলা প্রশাসক জানান।
পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী রনেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেন, ভারতে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে যা এখনো চলছে। মনু নদীর বাঁধ উপচে পানি এসে বাঁধ ভেঙেছে। নদীতে পানির স্রোত অত্যধিক। মনু নদীর পানি মনু রেলওয়ে ব্রিজের কাছে বিপৎসীমার ১৭৭ সেন্টিমিটার, শহরের চাঁদনীঘটে ৪৫ সেন্টিমিটার ও কমলগঞ্জের ধলাই নদীর পানি ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে মনু নদীর শহর প্রতিরক্ষা বাঁধ উপচে পানি ঢুকতে পারে।