গরুর দাম লাখ টাকা, চামড়ার দাম ৫০০!
এক লাখ টাকার গরুর চামড়ার দাম মাত্র ৫০০ টাকা। শুনে চমকে ওঠারই কথা কিন্তু এটিই বাস্তব। খুলনায় কোরবানির পশুর চামড়া বাজারে এই অবস্থা বিরাজ করছে। এবার মহল্লায় মহল্লায় সামিয়ানা টাঙিয়ে পশুর চামড়া কেনার অস্থায়ী কেন্দ্র চোখে পড়েনি। বেশির ভাগ বড় বড় চামড়ার আড়ত অর্থ সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরও ঢাকা থেকে নির্ধারিত মূল্যে কোথাও চামড়া বিক্রি হচ্ছে না।
শুক্রবার বিকেলে খুলনা মহানগরের শেরে বাংলা রোডে আর পার হাউস মোড়ে সংযোগস্থলে একটি ইজিবাইকে করে কোরবানির আটটি বড় গরুর চামড়া নিয়ে আসেন কসাই ইদ্রিস আলী। চামড়া যাচাই করে আড়তদার জানতে চান কত করে দিতে হবে। ইদ্রিস আলী প্রতিটির জন্য দুই হাজার টাকা করে দাম চান। কিন্তু আড়তদার ৫০০ টাকা দাম বলেন। ক্ষিপ্ত হয়ে ইদ্রিস বলেন, ইয়ারকি মারেন না কি। তারপর দুজন দুজনের দিকে তেড়ে যান। পরে অন্যরা এসে পরিস্থিতি শান্ত করেন।
এরপর ইদ্রিস ৫/৬টি দোকান ঘুরে সেই চামড়ার তিনটি বিক্রি করেন ১ হাজার ৫০০ টাকা আর বাকি পাঁচটি বিক্রি করেন ৮০০ টাকায়। এ ধরনের পরিস্থিতি দেখা গেছে খুলনার বিভিন্ন জায়গায়। ক্রেতার সঙ্গে চামড়া নিয়ে দর কষাকষিতে প্রায়ই হেরে যাচ্ছেন বিক্রেতারা। ইদ্রিস আলী বলেন, ‘চামড়ার বাজার খারাপ তাই এই অবস্থা। আটটি গরুর মধ্যে দুটির দাম ছিল লাখ টাকার উপরে। গত বছর যে দামে চামড়া বিক্রি হয়েছে এবার তার চেয়ে অর্ধেক দামে বিক্রি হচ্ছে।’ তিনি জানান, ঈদের আগে এই আড়তেই তিনি যে দামে চামড়া বিক্রি করে গেছেন আজ সেই দামের চেয়ে কম দাম বলছে, অথচ কোরবানির চামড়ার দাম বেশি হয়। এ ছাড়া ঈদের আগে তারা যে দামে চামড়া বিক্রি করেছেন তার চেয়ে কম দাম ধরে তিনি এই চামড়া কিনে এনেছেন। আর এই আটটি গরুর চামড়া ছাড়ানো ও মাংস কাটার কাজ তিনি নিজে করেছেন। অতিরিক্ত কিছু লাভ হবে সেই আশায় এগুলো নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে যে দামে বিক্রি হলো তাতে তার মজুরির টাকার বড় অংশ নেই।
ওই একই মোড়ে কথা হয় রয়েল মহল এতিমখানার মাওলানা আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘এই চামড়ার দাম এভাবে কমে গেলে এতিমখানা বন্ধ হয়ে যাবে। কোরবানির পশুর চামড়া দানে এতিমখানা চলে।’ নূরনগর জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘তিনটি ছাগলের চামড়ার দাম ২৫০ টাকা। এটা কি করে সম্ভব? চামড়া ভারতে পাচার হওয়ার জন্যই ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে এই চামড়ার দাম কমিয়েছে।’
খালিশপুরের আব্দুর রব জানান, মিথ্যা মামলায় জেলে থাকার পর কিছু লাভের আশায় ১৫টি চামড়া কিনে এনেছেন দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা করে। ইজিবাইকে বিভিন্ন আড়ত ঘুরছেন কেউ হাজার টাকার উপরে দাম বলছে না। ক্ষোভের সঙ্গে অাব্দুর রব বলেন, ‘দেশে সব পণ্যের দাম যেখানে বাড়ছে সেখানে চামড়ার দাম কমছে এটা কোনো হিসাবে মিলছে না। নওয়াপাড়ার আকিজ ট্যানারি গত বছর ১৫০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে বলে শুনেছি। কিন্তু সেখানে চামড়ার দাম কমবে কেন?’
খুলনার চামড়া বাজারের এই দশার কথা বলতে গিয়ে আড়তদার মো. সেলিম দাবি করেন, ঢাকার বাইরে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ফুট ৪০ থেকে ৪৫ টাকা, কিন্তু খুলনায় তাঁরা কিনেছেন ৬০ থেকে ৭০ টাকা ফুট দরে। ৪০ টাকা ফুট হলে চামড়ার দাম হাজার টাকার উপরে হবে না। ট্যানারি মালিকরা তাঁদের টাকা দিচ্ছেন না। তাই তাঁরা কিনবেন কিভাবে। গত ঈদের টাকা এখনও বাকি আছে। আড়তদার মো. নাসিম জানান, খুলনা চামড়া আড়তদার সমিতির সভাপতি মো. আমানউল্লাহসহ অনেকেই এবার ঈদে চামড়া কিনছেন না, আবার অনেক আড়ত বন্ধ হয়ে গেছে। হাতে গোনা কয়েকজন আড়তদার এবার চামড়া কিনছেন।
তিনি বলেন, ‘যারা চামড়া কিনছেন তাদের ভবিষ্যৎ কী তা কেউ জানে না। চামড়া কিনে বাকিতে বিক্রি করতে হয়। একই কথা আড়তদার ডাবলু রহমানের। তিনি বলেন, ‘দাম কম বেশিতে খুলনার ব্যবসায়ীদের কোনো হাত নেই। চামড়া ব্যবসায়ীরা খুলনায় প্রচার করছেন বিদেশে চামড়া রপ্তানি হচ্ছে না। তাই চামড়ার দাম কমে গেছে।
তবে বিষয়টি তদারকির জন্য সরকারের ভূমিকা রাখা দরকার বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। না হলে আগামীতে চামড়া শিল্পের অস্তিত্ব নিয়ে শঙ্কায় পড়তে হবে।