তরিকুল ইসলামের মৃত্যুতে বিএনপির শোকদিবস কাল
বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য, খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ তরিকুল ইসলামের মৃত্যুতে আগামীকাল সোমবার দেশব্যাপী শোকদিবস পালন করবে বিএনপি। শোকদিবস উপলক্ষে দেশব্যাপী বিএনপির কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন ও বুকে কালো ব্যাজ ধারণ করবেন নেতাকর্মীরা।
আজ রোববার বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তরিকুল ইসলামের মৃত্যুতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা গভীরভাবে শোকাহত। আগামীকাল সকাল ১০টায় রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মরহুমের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর বেলা সোয়া ১১টায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় দ্বিতীয় জানাজা হবে। বাদ আসর যশোর ঈদগাহ ময়দানে জানাজা হওয়ার পর স্থানীয় কারবালা কবরস্থানে মরহুমের লাশ দাফন করা হবে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীকে শোকদিবসের কর্মসূচি পালন, জানাজা ও দাফনে শরিক হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিএফইউজে-ডিইউজের শোক
তরিকুল ইসলামের ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) নেতৃবৃন্দ। আজ এক যুক্ত বিবৃতিতে বিএফইউজে সভাপতি রুহুল আমিন গাজী ও মহাসচিব এম আবদুল্লাহ এবং ডিইউজে সভাপতি কাদের গনি চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, সাবেক তথ্যমন্ত্রী তরিকুল ইসলাম ছিলেন গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের সুহৃদ। রাজনীতিবিদ হিসেবেও তিনি ছিলন সৎ, নিষ্ঠাবান ও নিরহংকার। দেশ ও জাতির প্রতি ছিলেন কমিটেড। স্বৈর সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে গিয়ে তিনি নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হন। যশোর থেকে একটি দৈনিক প্রকাশ করে তিনি সফল গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব হিসেবেও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। গভীর দেশপ্রেম তাঁর রাজনীতির মূলমন্ত্র ছিল।
সাংবাদিক নেতারা তাঁর রূহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং পরিবার পরিজনের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম আজ বিকেল ৫টা ৫ মিনিটের রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭২ বছর।
তরিকুল ইসলামের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন।
দীর্ঘদিন ধরে তরিকুল ইসলাম ফুসফুসে সংক্রমণ, কিডনি জটিলতাসহ নানান শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলেসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী ও অনুসারী রেখে গেছেন।
তরিকুল ইসলামের ভাতিজা ও যশোর নগর বিএনপির সভাপতি মারুফুল ইসলাম জানান, কিডনি সমস্যার কারণে তরিকুল ইসলামকে নিয়মিত ডায়ালাইসিস দিতে হতো। আজ ডায়ালাইসিস দেওয়ার সময় তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। দুপুরের দিকে চিকিৎসকরা জানান, ডায়ালাইসিস দেওয়ার সময় তাঁর ‘হার্ট অ্যারেস্ট’ হয়। দেড়টার দিকে তাঁকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়। বিকেল ৫টার কিছুসময় পর তিনি মারা যান। আজ সন্ধ্যায় তরিকুলের মরদেহ তাঁর শান্তিনগরের বাসভবনে নেওয়া হয়।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন
১৯৪৬ সালের ১৬ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন তরিকুল ইসলাম। ১৯৬৩ সালে যশোর মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং একই কলেজ থেকে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) ডিগ্রি অর্জন করেন। পরের বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী তরিকুল ছাত্রজীবনেই বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী হিসেবে যশোর এমএম কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বৃহত্তর যশোর জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতিও ছিলেন তিনি। ১৯৬৮ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের জন্য তিনি নয় মাস কারাবন্দি ছিলেন। ৬৯-এর গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় গণআন্দোলনে নেতৃত্বদানের জন্য আবারও কারাবন্দি হন।
১৯৭০ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে পরিচালিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ) যোগ দেন তরিকুল ইসলাম। ১৯৭৩ সালে তিনি যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ সালে তিনি একই পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে বিএনপিতে যোগদানের পর তিনি যশোর সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং একইসঙ্গে তিনি দলটির জেলা আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালে তিনি সড়ক ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। একই বছর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের পর তরিকুল ইসলামকে আটক করা হয়। তিন মাস অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে তাঁর ওপর নির্যাতন করা হয়। ১৯৮৬ সালে তিনি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পান। ১৯৯১ সালে তরিকুল ইসলাম সমাজকল্যাণ ও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং পরের বছর একই মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। এ সময় তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি এ মন্ত্রণালয়েরও পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান।
২০০১ সালের নির্বাচনে যশোর-৩ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তরিকুল ইসলাম এবং খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। পরে তিনি তথ্য মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের পাশাপাশি যশোরের রাজনীতিতে এবং এলাকার উন্নয়নে তরিকুল ইসলাম অসামান্য অবদান রেখে গেছেন- এ কথা তাঁর কট্টর সমালোচকরাও স্বীকার করেন। তাঁর মৃত্যুতে দেশ যেমন একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিককে হারাল, তেমনি যশোরেও তৈরি হলো একটি বড় শূন্যতা।